বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে খোশমেজাজে নেইমার
বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে খোশমেজাজে নেইমার

নেইমারের হাতেই বিশ্বকাপ?

আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিততে দেখেছেন? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তার মানে তো আপনি এরই মধ্যে চালশেতে আক্রান্ত অথবা আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন। কীভাবে নিশ্চিত হলাম, বুঝতে পারছেন না? সরল গণিত রে ভাই, সরল গণিত।

সেই গণিতে যাওয়ার আগে চলুন, একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। সবচেয়ে কম, কত বছর বয়সের স্মৃতি মনে থাকে মানুষের—চার বছর? পাঁচ বছর? এ নিয়ে গবেষণা নিশ্চয়ই আছে। সেটি আর এখন খুঁজতে ইচ্ছা করছে না। তা বোধ হয় জরুরিও নয়। অনুমান তো করাই যায়। দু–একটা ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, তবে উত্তরটা ওই চার–পাঁচ বছরই হয়তো হবে। তা-ই যদি হয়, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতি মনে করতে পারলে আপনার বয়স তো চল্লিশ হয়ে গেছেই। আর সুমন চট্টোপাধ্যায় তো কবীর সুমনে রূপান্তরিত হওয়ার অনেক আগেই গেয়ে রেখেছেন, চল্লিশ পেরোলেই চালশে...।

আর্জেন্টিনার দুই বিশ্বকাপের দ্বিতীয়টি ১৯৮৬ সালে। অর্থাৎ আজ থেকে ৩৬ বছর আগে। যার মানে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে আর্জেন্টিনাকে উল্লাস করতে দেখেছে, এমন কোনো কিশোর–তরুণ এই পৃথিবীতে নেই। বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে যাঁরা ‘লাইভ’ দেখেছেন, সবাই কমপক্ষে মধ্যবয়সী।

এতটা না হলেও ব্রাজিলের ঘটনাও তো কাছাকাছিই। পাঁচ বিশ্বকাপের সর্বশেষটি সেই ২০০২ সালে। এরপর পেরিয়ে গেছে ২০ বছর। কাফুর হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখার স্মৃতি মনে করতে পারলে আপনার বয়সও তো কমপক্ষে ২৪–২৫। ভাবতে বিস্ময়ই লাগে, তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই দলের কোনোটিকেই বিশ্বকাপ জিততে দেখেনি এই বিশ্বের তারুণ্য!

বিশ্বকাপ শুরুর ২৮ বছর পর প্রথম ট্রফি জিতেছিল ব্রাজিল। সেটিকে বাদ দিলে বিশ্বকাপের সফলতম দলের শিরোপা জয়ে এত লম্বা বিরতি এর আগে একবারই। ফুটবলকে অন্য মাত্রা দিয়ে ১৯৭০ সালে পেলের ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের পর ২৪ বছরের সাফল্য-খরা। এ নিয়ে কত কথাই না হয়েছে! যার বড় একটা কারণ ছিল, বিশ্বকাপ জয়ের মতো দল নিয়েও, বিশ্বকাপ জেতার মতো খেলেও ব্রাজিলের বারবার ব্যর্থ হওয়া। ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্যর্থতা তো কিংবদন্তিতুল্য, ফুটবলেই যেটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। যে কারণে পরের দুটি বিশ্বকাপ নিয়ে অত কথা হয় না। না হলে ১৯৮৬ ও ১৯৯০ বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলের শূন্য হাতে ফেরাও তো বড় অঘটনই ছিল। 

দুই যুগের ওই খরার আগে বিশ্বকাপে ব্রাজিলের আশ্চর্য ধারাবাহিকতারও বড় ভূমিকা ছিল ওই ব্যর্থতা নিয়ে বিস্ময়ের। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত চার বিশ্বকাপের তিনটিই জিতেছিল ব্রাজিল। ২৪ বছরের খরা ঘোচানোর পরও এমন একটা সোনালি সময় এসেছিল। পরের দুটি বিশ্বকাপেরও ফাইনাল খেলে ব্রাজিলের জার্সিতে যোগ হয়েছিল আরও একটি তারা। ১৯৯৪ থেকে ২০০২—টানা তিন ফাইনাল খেলে দুটি জেতা দলটি কিনা পরের চার বিশ্বকাপের একটিরও ফাইনালে উঠতে পারেনি। সেই উঠতে না পারারও একটা প্যাটার্ন ছিল। প্রতিবারই ইউরোপিয়ান কোনো দলের বিপক্ষে হেরে বসেছে ব্রাজিল।

খুদে ভক্তদের সঙ্গে নেইমার

ইউরোপিয়ান দলের বিপক্ষে বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে আর্জেন্টিনার স্বপ্নও। মহাদেশে আবদ্ধ না থেকে এ ক্ষেত্রে অবশ্য আরও সুনির্দিষ্টভাবে একটি দেশের কথাই বলা যায়। ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে যে দলের কাছে হেরে ডিয়েগো ম্যারাডোনা মাঠেই কেঁদেছিলেন, সেই দল এরপর আর্জেন্টিনাকে কাঁদানোটাকে বলতে গেলে অভ্যাসই বানিয়ে ফেলেছে। দেশ বলুন বা দল—নামটা আপনি জানেন বলে অনুমান করি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বৈরিতা নিয়ে এত কথা, কিন্তু আসলে তো আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সবচেয়ে অপ্রিয় দল হওয়ার কথা জার্মানির। আচ্ছা, ব্রাজিলের সমর্থকদেরও কি তা-ই হওয়ার কথা নয়! কারণ জানতে চাইছেন? কী আশ্চর্য, ২০১৪ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের কথা ভুলে গেলেন নাকি!

যাক, এতক্ষণে তা-ও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বাইরে আরেকটা দলের নাম এল! বিশ্বকাপ নিয়ে লেখায় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকে নিয়ে এতটা জায়গা খরচ করে ফেলার কারণটা ব্যাখ্যা করার যদিও কোনো প্রয়োজন দেখছি না। অন্য দলের সমর্থকেরা একটু রাগ করতেই পারেন। তবে তাঁদেরও খুব ভালোই জানা, বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা।

নিজেদের শিরোপা-খরা ঘোচানোর মিশন তো আছেই, এর সঙ্গে এবার বড় একটা দায়ও কিন্তু আছে এই দুই দলের। মহাদেশীয় সম্মান রক্ষার দায়। ‘রক্ষা’র চেয়ে বলা ভালো পুনরুদ্ধারের দায়। বিশ্বকাপের শুরু থেকে ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার সমানে সমান দ্বৈরথে অনেক দিনই ইউরোপের একাধিপত্য। সর্বশেষ চার-চারটি বিশ্বকাপের ট্রফি গেছে ইউরোপে। এর একটি লাতিন আমেরিকা থেকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ নিয়ে আসাও এর অন্তর্ভুক্ত। যে কীর্তি প্রসঙ্গে আবারও এসে যাচ্ছে জার্মানির নাম।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তো আছেই, বরাবরের মতো জার্মানিও বিশ্বকাপের বড় দাবিদার। পগবা-কান্তেকে হারিয়ে ফেলার পরও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সও তা-ই। যদিও গত কয়েকটি বিশ্বকাপের ইতিহাস মনে রাখলে মানে মানে প্রথম রাউন্ড পেরোনোর জন্য প্রার্থনায় বসা উচিত ফরাসিদের। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেওয়ার ধারাটা একরকম নিয়মিত হয়ে যাওয়াটা তো ২০০২ সালে ফ্রান্সকে দিয়েই শুরু।

দল থেকে আলোচনাটা খেলোয়াড়ে এলে অবধারিতভাবেই প্রথমে আসবেন লিওনেল মেসি। আর্জেন্টাইন জাদুকরের শেষ বিশ্বকাপ, শেষ বিশ্বকাপ তাঁর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরও। মুড়িমুড়কির মতো ব্যালন ডি’অর ছাড়াও দলীয় যত কিছু জেতা সম্ভব, তার সবই জিতেছেন এই দুজন। শুধু বিশ্বকাপটা ছাড়া। কাতার ২০২২ কি তাহলে এই দুজনের কারও একমাত্র অপ্রাপ্তি ঘোচানোর বিশ্বকাপ?

গত কয়েক বছরে এই দুজনের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়েছে যাঁর নাম, তাঁরও নাকি এটা শেষ বিশ্বকাপ হতে পারে। যদিও বয়স চিন্তা করলে অন্তত আরও একটি বিশ্বকাপ খেলতে না পারার কোনো কারণ নেই নেইমারের। ৩১তম জন্মদিন এখনো মাস আড়াই দূরে। তাহলে শেষ বিশ্বকাপ বলে রব উঠছে কেন? কারণ, নেইমার নিজেই নাকি ঘনিষ্ঠজনদের এমন বলেছেন। মেসির নিশ্চিতভাবেই শেষ বিশ্বকাপ, রোনালদোরও তা-ই; নেইমারও এই দুজনের দলে যোগ হয়ে গেলে তো শেষটা রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতাটাও ত্রিমুখী হয়ে যায়। 

ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতার কথা বললে নেইমার তিনজনের মধ্যে তৃতীয় হয়েই থেকেছেন এত দিন। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে, এবারের বিশ্বকাপে আসল জয়টা তাঁরই হবে। ফুটবলীয় যুক্তিও চাইলে দেওয়া যাবে, তবে বিশ্বকাপ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে আমি মনের কথাই বেশি শুনি। তা মন কী বলছে? 

মন বলছে, এটা হবে নেইমারের বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ।