আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ক্রীড়াঙ্গনে চলেছে দেদার দলীয়করণ। সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের রূপরেখা পাওয়া যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তার আগে বিগত দিনে ক্রীড়াঙ্গনের হালচাল নিয়ে এই ধারাবাহিক। আজ শেষ পর্ব।
স্বাধীনতার পর ক্রীড়া ফেডারেশন গঠিত হওয়ার সময় সরকার-মনোনীত সংগঠকেরাই ফেডারেশন পরিচালনা করতেন। তবে তখন অনেক নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক ছিলেন, যাঁরা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো’ কাজ করতেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এলে তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সময়ে ১৯৯৮ সালে প্রথম নির্বাচন হয় ক্রীড়াঙ্গনে। প্রথম নির্বাচনটা হয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থায়। সে সময় রিটার্নিং অফিসার ছিলেন এনএসসি সচিব ও পরে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি এ এস এম আলী কবীর। ২০২২ সালের জুনে মৃত্যুর আগে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। এটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, বলা যাবে না। তবে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকায় নির্বাচনটা অর্থবহ হচ্ছে না।’
অর্থবহ না হলেও নির্বাচনের মাধ্যমে ফেডারেশনগুলোর কমিটি হয়ে আসছে। যদিও কোনো কোনো ফেডারেশনে দীর্ঘদিন নির্বাচন হয়নি। যেমন ২০০৮ সালের পর ১৬ বছর ধরে ভারোত্তোলন ফেডারেশনে আর নির্বাচন হয়নি। মহিলা ক্রীড়া সংস্থায় সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০১২ সালে।
এনএসসির আইন অনুযায়ী, একটি ক্রীড়া ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির মেয়াদ চার বছর।কিন্তু চার বছর পর সময়মতো নির্বাচন হয়নি অনেক ফেডারেশন বা সংস্থায়। মহিলা ক্রীড়া সংস্থায়ও হয়নি, সেখানে অ্যাডহক কমিটি করা হয় ২০১৭ সালের ১ মার্চ। এ-সংক্রান্ত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রজ্ঞাপনে লেখা ছিল, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন সম্পন্ন করবে অ্যাডহক কমিটি। কিন্তু সাড়ে সাত বছর পার হলেও সংস্থার তৎকালীন সভানেত্রী ও হুইপ মাহবুব আরা গিনি নির্বাচনের ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ আছে। অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল ষাটের দশকের ক্রীড়াবিদ হামিদা বেগমকে। তিনি ২০২২ সালের মার্চ মাসে মারা গেছেন।
ক্রীড়া ফেডারেশনে নির্বাচন হয়েছে খুব কম ফেডারেশনেই। যা-ও হয়েছে, সমঝোতার কমিটি বানিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে তা জমা দেওয়া হয়েছে। তাতে পদ ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে। এনএসসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে নির্বাচিত কমিটি আছে ২৯টি ফেডারেশনে। বাকি ২৬টিতে সরকার-মনোনীত অ্যাডহক কমিটি।
পেশিশক্তির জয়
যেসব ফেডারেশনে গত ১৫ বছরে নির্বাচন হয়েছে, তার দু-একটি বাদে বাকিগুলোয় জাতীয় নির্বাচনের মতো সাজানো নাটকই হয়েছে বেশি। কোনো কোনোটি দেখেছে অর্থ আর ক্ষমতার আস্ফালন। যেমন গত বছর জুলাইয়ে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের নির্বাচনে একজন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীকে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি। ক্যাসিনো সাঈদ নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া মমিনুল হক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক পদে। এই পদে হকির দীর্ঘদিনের ও পরীক্ষিত সংগঠক সাজেদ এ আদেল প্রার্থী হতে পারেন আভাস পেয়েই নানা ছলাকলায় মমিনুল হক সাজেদের দুটি ক্লাবেরই কাউন্সিলরশিপ বাতিল করে দেন।
ঢাকার প্রথম বিভাগ হকি লিগে সাজেদ আদেলের দুটি ক্লাব। দুটিরই সভাপতি তিনি। নির্বাচনের জন্য হকি ইউনাইটেডের কাউন্সিলর হিসেবে নিজের নাম পাঠান আদেল। কম্বাইন্ড স্পোর্টিংয়ের কাউন্সিলর হিসেবে পাঠান জহিরুল ইসলামের নাম। কিন্তু নাম দুটি গ্রহণ করেনি হকি ফেডারেশন। না করার যুক্তি, এই দুটি ক্লাব থেকে কাউন্সিলর হিসেবে অন্য নাম জমা পড়েছে। এ নিয়ে এনএসসি গঠিত নির্বাচন কমিশনে গিয়ে কোনো ফল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আদালতে যান সাজেদ ও জহিরুল। ফল অবশ্যই তাঁর পক্ষে যায়নি।
২০১৬-এর ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০টি ক্রীড়া ফেডারেশনের নির্বাচনে ৯টিতেই কোনো ভোট হয়নি। একক পরিষদ জমা দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যায় শুটিং, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, জিমন্যাস্টিকস, হ্যান্ডবল, ভলিবল, আর্চারি, রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের কমিটি।
মমিনুল হক নিজের পছন্দের কমিটি পাস করিয়ে নেন অনায়াসে। আর সেই কমিটিতে হকির সঙ্গে সম্পর্কহীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুজন কাউন্সিলরকে জায়গা দেন মমিনুল। যাঁদের জোর করে ক্লাব থেকে কাউন্সিলর করে আনা হয় বলে অভিযোগ আছে। হকির অনেক চেনা মুখকে বাদ দিয়ে কমিটিতে ঢোকান নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের গানম্যান ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির এপিএসকে।
তার আগে ২০১৮ সালে হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে মমিনুল হক টাকার জোরে হারিয়ে দেন বাংলাদেশের হকির কিংবদন্তি আবদুস সাদেকের মতো প্রার্থীকে। ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচনে টাকা কত বড় প্রভাবক, এটা তার বড় প্রমাণ হয়ে আছে।
বিনা ভোটে পাসের হিড়িক
‘ক্রীড়া ফেডারেশনে নামেই নির্বাচন’ শিরোনামে ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর প্রথম আলোয় একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচনী উত্তাপ বলে কিছু নেই। একের পর এক বিনা ভোটে কমিটি হচ্ছে। ২০১৬-এর ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০টি ক্রীড়া ফেডারেশনের নির্বাচনে ৯টিতেই কোনো ভোট হয়নি। একক পরিষদ জমা দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যায় শুটিং, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, জিমন্যাস্টিকস, হ্যান্ডবল, ভলিবল, আর্চারি, রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের কমিটি।
ফুটবল-ক্রিকেটে নির্বাচন হয় ফিফা ও আইসিসির নিয়মে। কিন্তু সেখানেও ক্ষমতাসীনদের প্রভাব থাকে। নানাভাবে নির্বাচন প্রভাবিত করার অভিযোগ আছে। যার কিছু ওপেন সিক্রেট। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পদে নাজমুল হাসানের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই থাকত না। কাজী সালাউদ্দিন ভোটাভুটিতে পাস করলেও ভোট নিয়ে থেকেছে নানা প্রশ্ন। ফুটবল-ক্রিকেটের নির্বাচন মানে টাকার খেলা। এটা ক্রীড়াঙ্গনে সবার মুখেই মুখেই শোনা যায়।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির নিয়ম অনুযায়ী অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসতে হয়। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে অলিখিতভাবে সেনাপ্রধানকে রাজনৈতিক সরকারগুলো মনোনয়ন দিয়ে আসছিল এত দিন। এই পদে কখনো নির্বাচন হয়নি। কারণ, সেনাবাহিনী প্রধান ছাড়া আর কেউ প্রার্থীই হন না।
ফোরামের দাপট
১৯৯৬ সালে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদ বা ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রয়াত মহাসচিব জাফর ইমাম। এই ফোরামই ক্রীড়াঙ্গনে অনেক ফেডারেশনের নির্বাচনে প্রভাবক হয়ে ওঠে। অনেকে এটিকে ক্রীড়াঙ্গনের বিষফোড়া বলেন। সাবেক ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কামরুন নাহার ডানার ভাষায়, ‘অনেককে বলতে শুনি, জাফর ইমাম ভাই মরে গেছেন, ক্রীড়াঙ্গনকে মাইরাও গেছেন।’
নির্বাচন কীভাবে ফোরামের হাতে জিম্মি, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, একটা ক্রীড়া ফেডারেশনে ভোট ৬০টি, যার মধ্যে জেলার প্রায় ৩৫টি। ঢাকার ক্লাব বা অন্যান্য মিলিয়ে ২৫টি। ফলে ফোরাম যা চায়, তাই হয়। এ সুযোগে অনেক অযোগ্য লোকও ঢুকে পড়ে ক্রীড়া ফেডারেশনে। ফোরামের প্রভাব ও ক্ষমতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে জেলার কোনো সংগঠককে এনে জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেলার কর্মকর্তা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন না, এমন নয়। তবে বেশির ভাগ সময়ই খেলাটার সঙ্গে ওই কর্মকর্তার তেমন যোগ ছিল না। যে কারণে ফেডারেশনের কার্যক্রমের মতো খেলাটাও কোনো গতি পায়নি।
একই ব্যক্তি জেলা ক্রীড়া সংস্থা, বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা ও জাতীয় ফেডারেশনে কেন থাকবেন, এটাও একটা বড় প্রশ্ন। অথচ নিয়মিতই হয়ে এসেছে এমন। বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান পটুয়াখালী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন। বিএনপি আমলে এই পদে ছিলেন ফেনী জেলা ক্রীড়া সংস্থার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন বুলবুল। যাঁকে ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য সার্চ কমিটির সদস্য করে পরে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
কখনো কখনো ফোরামের বিরুদ্ধে কাউকে পাস করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরার অভিযোগ থাকলেও ক্রীড়াঙ্গনে দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ব্যালট পেপার ছাপানোরই দরকার হয় না। ভোটাভুটিই তো নেই। অথচ নামেই ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাচিত কমিটি!
ব্যাডমিন্টনের সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ও ক্রীড়া সংগঠক কামরুন নাহার ডানা তাই নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে বলেছেন, ‘আগে এনএসসি ভালো ভালো লোকদের নিয়ে অ্যাডহক কমিটি করত। কিন্তু আমরা মনে করলাম, ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্র দরকার। তাই নির্বাচন চাইলাম। কিন্তু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের গঠনতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে খেলার সঙ্গে সম্পর্কহীন সুযোগসন্ধানীরা ক্রীড়াঙ্গনে ঢুকে যায়। ফলে পরীক্ষিত, এবং ক্রীড়া উন্নয়নে আন্তরিক ব্যক্তিরা হারিয়ে যায়। এখন আমূল বদল দরকার গঠনতন্ত্রে। এমন কিছু করতে হবে, যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা ক্রীড়াঙ্গনে আসতে পারেন।’