কাঠমান্ডু থেকে ঢাকা পর্যন্ত বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের বিমানযাত্রায় সঙ্গী ছিলেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বদিউজ্জামান। শুনিয়েছেন সেই গল্প
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফিটা কোলের ওপর রেখে ঢাকায় ফেরার বিমানের অপেক্ষা করছিলেন সানজিদা আক্তার। পাশের চেয়ারে কৃষ্ণা রানী সরকার, মাসুরা পারভীনরা তখন মুঠোফোনে ব্যস্ত। কিন্তু মুঠোফোনের স্ক্রিনে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারছিলেন না কেউই। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন শেষে ঢাকাগামী বাংলাদেশি যাত্রীদের অভিনন্দন গ্রহণ করতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে যেতে হলো। একটু পরপর ট্রফিসহ ফুটবলারদের সঙ্গে ছবি ও সেলফি তুলতে লাগলেন যাত্রীরা। শুধু বাংলাদেশিরাই নন, বিমানবন্দরে থাকা বিদেশি যাত্রীরাও সাফজয়ীদের সঙ্গে ছবি তুললেন।
দলের সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার। বিমানে ওঠার আগে মেয়েদের এক দফা কাছে ডেকে নেন এই কর্মকর্তা। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মাহফুজার কথাগুলো শোনেন সাবিনারা। ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর আনুষ্ঠানিকতা কেমন হবে, ছাদখোলা বাসে কীভাবে মেয়েরা উঠবেন, কতটা শৃঙ্খলা বজায় রেখে ছাদে উঠতে হবে, সে পরামর্শ দিলেন। বাসে মেয়েদের পাশে যেন আর কেউ না দাঁড়াতে পারেন, বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের ম্যানেজার আমিরুল ইসলামকে সেটা তদারক করার নির্দেশ দেন মাহফুজা।
দেশে ফেরার জন্য তর সইছিল না মারিয়া মান্দা, মণিকা চাকমাদেরও। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৩৭২ বোয়িং উড়োজাহাজটি নেপালের আকাশ ছুঁতেই মেয়েরা আনন্দে একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠেন।
সাফজয়ী নারী দলের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে কাল। বিমানে বসে খবরটা শুনতেই আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠেন মেয়েরা।
চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের বহন করা বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রু ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার হোসেন। দেশের হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে খেলা সানোয়ার ছিলেন ২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ দলেও।
চ্যাম্পিয়ন ফুটবলারদের সঙ্গে একই বিমানে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবানই বলছিলেন সাবেক এই ক্রিকেটার। নিজে খেলোয়াড় ছিলেন বলেই কিনা কেবিন ক্রু–সত্তা থেকে কিছুক্ষণ সময়ের জন্য হলেও বেরিয়ে এলেন। ফুটবলারদের জন্য মিষ্টির প্যাকেট খুলে নিজে হাতে সবাইকে খাওয়াতে লাগলেন। গর্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘একজন খেলোয়াড় হিসেবে শুধু ফুটবল, ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশের যেকোনো খেলায় কেউ ভালো করলেই গর্ব বোধ করি। ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। একসময় বাংলাদেশের ফুটবলে বিশাল গৌরব ছিল। যদিও এখন কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু আশা করি, মেয়েদের এত বড় অর্জনে বাংলাদেশের ফুটবল আবার আগের হারানো গৌরব ফিরে পাবে।’
সাবিনাদের খেলা দেখে মুগ্ধ সানোয়ার বলছিলেন, ‘মেয়েরা যা করেছে, সেটা পুরো দেশের জন্যই গৌরবের ব্যাপার। ওরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসাধারণ ফুটবল খেলেছে। ওদের খেলায় মুগ্ধ হয়েছি আমি।’
ফুটবলারদের বহন করা বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন আহমেদ ইমরান আশির দশকে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে ফুটবল খেলেছেন। ২০০৪ সালে পাইলট হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ বিমানে। ২০১১ সালে ঢাকায় প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলতে আসে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশ বিমানের সেই ফ্লাইটেরও ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি।
আনন্দিত ইমরানের কথা, ‘কলকাতা থেকে আর্জেন্টিনা দল ঢাকায় আসার সময় বাংলাদেশ বিমান থেকে আমাকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেদিনের চেয়েও আজ বেশি আনন্দিত আমি।’
এমন ফ্লাইট বহন করতে পেরে গর্বিত এই পাইলট, ‘আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় ফ্লাইট এটা। এই মেয়েদের এমন অর্জন অসাধারণ। এই ফ্লাইটে ওদের সান্নিধ্য পাওয়ায় আমি গর্বিত।’
বিমানে উঠে ফুটবলারদের অনেকে হাসি–আড্ডায় মেতে ওঠেন। কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনেন। চিপস আর চানাচুরের প্যাকেট খুলে কেউ সতীর্থদের নিয়ে খাওয়া শুরু করেন। বিমানবন্দরে নেমে ছবি তুলতে হবে ভেবে, মেয়েদের অনেকে সাজগোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন একসময়। মারিয়া মান্দা চুল বেঁধে দেন সানজিদার। সাজেদা খাতুন মেকআপ বক্স বের করে লিপস্টিক লাগালেন ঠোঁটে।
কালো সানগ্লাস চোখে দিয়ে নিজেকে কেমন লাগছে, সেটা মুঠোফোনের সেলফি মোডে দেখতে লাগলেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের সঙ্গে ট্রফি হাতে ছবি তুললেন সানোয়ারসহ অন্য কেবিন ক্রুরা। ঢাকায় নামার আগেই নিজেদের ব্যাগ থেকে সোনালি পদকটা বের করে গলায় পরে নেন ফুটবলাররা।
বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ কেকের আয়োজন করেছিল। বিমান থেকে নামার আগে সেই কেক কাটা হয়। এরপর ফুটবলারদের কেক খাইয়ে দেন সানোয়ার। সবশেষে বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় মেয়েদের।