মুর্শিদার (বাঁয়ে) ৪৬ রানের ইনিংস হেমলতার ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে ম্লান হয়ে গেছে। আজ সিলেটে
মুর্শিদার (বাঁয়ে) ৪৬ রানের ইনিংস হেমলতার ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে ম্লান হয়ে গেছে। আজ সিলেটে

মুর্শিদা-হেমলতার দুই ধরনের ইনিংস এবং একটি ‘আকুতি’

‘এখানকার কন্ডিশন চেন্নাইয়ের মতো। বল ঘোরে, নিচু হয়। আমার জন্য সহজ ছিল…।’
সংবাদ সম্মেলনে কথাটা শেষ করতে পারলেন না দয়ালান হেমলতা।

বৈরী আবহাওয়ায় হুট করেই লোডশেডিং সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে। গরমে দেশের অনেক জায়গা থেকেই লোডশেডিংয়ের খবর আসছে, সেটি নতুন কিছু নয়। তবে সিলেটে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল, বজ্রপাতের শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছিল সংবাদ সম্মেলনকক্ষেও।

হেমলতা এরপরও কথা শেষ করতে চাইলেন, কিন্তু অফিশিয়াল ব্রডকাস্টারের আপত্তিতে তা আর হলো না। বিদ্যুতের দেখা পাওয়া গেল আরও কিছুক্ষণ পর। তার আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শেষ’ করে দেওয়া হলো সংবাদ সম্মেলন। হেমলতার কথা হয়তো বাকি থেকে গেল কিছুটা, তবে তার আগেই যা বলার বলে গেলেন।

সিলেটে দ্বিতীয় ম্যাচের ছবিটা যেন তাতে ভেসে উঠল আরেকবার। বৃষ্টিতে ভারতের ইনিংসে ৫.২ ওভারের পর আর খেলা হতে পারেনি। কিন্তু তার আগেই হেমলতার ২৪ বলে ৪১ রানের ঝোড়ো ইনিংসে যা করার তা করে ফেলেছে ভারত

****
বাংলাদেশের ইনিংসের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে মিড অফ থেকেই সিঙ্গেলটা চুরি করতে চেয়েছিলেন মুর্শিদা খাতুন। তবে ‘সিনিয়র’ ক্রিকেটারের সে ডাকে সাড়া দেননি সোবহানা মোস্তারি। রানটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেত।

সোবহানা কেন ডাকে সাড়া দিলেন না, এ নিয়ে একটু ক্ষুব্ধই হতে দেখা গেল মুর্শিদাকে। আকারে-ইঙ্গিতে দুজনের কথা চলার পর শেষ পর্যন্ত যেন নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন মুর্শিদা। একটু পর গিয়ে সোবহানার গায়ে হাত দিয়ে সেটি বুঝালেনও।

হঠাৎ ‘উত্তেজিত’ হয়ে গেলেও মুর্শিদা এ ম্যাচে নিজের দায়িত্বটা পালন করেছেন বেশ ভালোভাবেই। মাঝের ওভারে দ্রুত ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর চাপটা নিজে নিতে চেয়েছেন, গড়তে চেয়েছেন জুটি। শেষ ওভার পর্যন্ত টিকে ছিলেন। যদিও শেষ দিকে গিয়ে নাহিদা আক্তার তাঁর ডাকে সাড়া দিতে গিয়েই হয়েছেন রানআউট, মুর্শিদা নিজেও রানআউট হয়েছেন ফ্রি হিটে।

বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচ জিতে সিরিজে ২–০ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে ভারত

৪৯ বলে ৪৬ রান করেই থামতে হয়েছে তাঁকে। টপ অর্ডারের (প্রথম তিনজন) ব্যাটার হিসেবে বাংলাদেশের সর্বশেষ ফিফটিটা করেছিলেন মুর্শিদাই, গত বছরের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এ ম্যাচে নাগালে থাকলেও আরেকটি ফিফটি পাননি। তিনি থাকলে দলের রান আর কয়েকটি বেশি হতো, সে আক্ষেপেও পুড়েছেন।
মুর্শিদা জানতেন, এমন উইকেটে ১১৯ রানের সম্বল ভারতকে আটকাতে যথেষ্ট নয়।

****

মুর্শিদা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন প্রায় ছয় বছর ধরে। শামীমা সুলতানার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের টপ অর্ডার তাঁর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। কিন্তু শেষ কয়েক ম্যাচে টপ অর্ডারের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ছিলেন, সর্বশেষ ৫ ম্যাচে সর্বোচ্চ ইনিংসটি ছিল ২০ রানের, চারবারই আউট হয়েছেন ৮ রানের নিচে। মানসিক দিক দিয়ে চাপে ছিলেন একটু, সেটি বললেন নিজে থেকেই।

এ ম্যাচে টপ অর্ডার একটু আশা দেখাল, কিন্তু ধস নামল মিডল অর্ডারে। গত কয়েক ম্যাচে যে নিগার সুলতানা একাই খেলেছেন প্রায়, তিনিও আজ বড় করতে পারেননি ইনিংস।

মুর্শিদা জানতেন, তাঁর ওপর বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়েছে, ‘ওপেনিং জুটি ভালো ছিল, দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলছিলাম। দ্রুত ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর আমার ওপর একটু চাপ চলে আসে। আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী বল ধরে খেলার চেষ্টা করেছি।’

মুর্শিদার ইনিংস টি–টোয়েন্টির দাবি মেটাতে পারেনি

কিন্তু এরপরও ঠিকই আক্ষেপ সঙ্গী হয়েছে তাঁর, ‘আরও দু-একটা শট যদি ভালো খেলতাম, আরেকটু ক্যারি করতাম, তাহলে ভালো হতো। এই উইকেটে আসলে (১১৯ রানের স্কোর) ততটা ভালো না। আমাদের লক্ষ্য ছিল ১৪০ রানের বেশি। তবে ক্যারি করতে পারিনি। আমারও কিছু ভুল ছিল। শেষ পর্যন্ত খেলতে পারলে হয়তো আরও ১০-১৫ রান বেশি হতো।’

সেটি হয়নি। ভারতকেও আর আটকাতে পারেনি বাংলাদেশ।

****

মুর্শিদার মতো হেমলতারও আন্তর্জাতিক অভিষেক ২০১৮ সালে। কিন্তু এ সময়ে আজকের আগে তিনি খেলেছেন মাত্র ২৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। যার সর্বশেষটি ছিল ২০২২ সালের অক্টোবরে, এ মাঠেই এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

সে ম্যাচে ব্যাটিং করেননি, বাদ পড়েন এরপর। হেমলতা মূলত ফিরেছেন ঘরোয়া প্রতিযোগিতার পারফরম্যান্স দিয়ে। ডব্লুপিএলে (নারী আইপিএল) ১৫৭.২৯ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছিলেন গুজরাট জায়ান্টসের হয়ে। রেলওয়ের হয়েও ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের সুনাম আছে তাঁর।

ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে হেমলতা

ঘরোয়াতে খেলার অভিজ্ঞতা আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে তাঁকে, ‘অনেক ভালো লাগছে। ভারতের হয়ে খেলা, অবদান রাখার অনুভূতি সব সময়ই অসাধারণ। ঘরোয়াতে আমি ৪-৫ নম্বরে খেলতাম। এখানে তিনে খেললাম। ডব্লুপিএলে নতুন বলে খেলেছি। ফলে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম।’

বৃষ্টি যে আবার নামতে পারে, ভারত ইনিংসের শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল সেটি। তবে হেমলতা সেসব খেয়াল করেননি, ‘আবহাওয়া কতটা পরিবর্তন হচ্ছে, তা দেখিনি। নিজেদের শক্তি অনুযায়ী খেলতে চেয়েছি। ১২০ রানের লক্ষ্য, তেমন পরিকল্পনা করিনি স্কোর নিয়ে। নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা রাখতে চেয়েছি—আমার, স্মৃতির, শেফুর কোনটা শক্তি। মৌলিক ব্যাপারগুলো ঠিক রাখতে চেয়েছি।’

সেসব ঠিক রেখেই হেমলতা ব্যাটিং করেছেন ১৭০.৮৩ স্ট্রাইক রেটে। তিনে নেমেছিলেন, কিন্তু ম্যাচটা ‘ফিনিশ’ হয়েছে তাঁর ব্যাটিংয়েই। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় উঠে যাওয়ার পথে দলের কাছ থেকে অভিনন্দনও পেলেন অমনই। তাঁকে জায়গা করে দিয়ে অভিনন্দন জানাতে দেখা গেল স্মৃতি মান্ধানাকেও।

মুর্শিদার ৪৬ রানের ইনিংসই যেখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘লড়াকু’, সেখানে এমন লম্বা বিরতির পর হেমলতা এসেই খেললেন অমন ইনিংস। দুই দলের মধ্যে পার্থক্যটাও কি ফুটে উঠল না তাতে?

সংবাদ সম্মেলনে মুর্শিদা

এমন প্রশ্নের উত্তরে মুর্শিদা পরে বললেন, ‘অবশ্যই ওরা অনেক ভালো খেলে। শেষ আইপিএল খেলে এল। ওদের মেন্টাল সেট-আপ অমন ছিল। আমাদেরও যদি টুর্নামেন্টগুলা হয়, টি-টোয়েন্টির জন্য আরও টুর্নামেন্ট হয়, তাহলে আমরাও (এমন মানসিক দিক দিয়ে শক্ত থেকে) আসতে পারব।’

দুই দল আর দুই দেশের ক্রিকেট কাঠামোর পার্থক্য হয়তো ফুটে ওঠে মুর্শিদার ওই কথাতেই। যেটিই হয়তো মাঠে অনূদিত হয় দিনের পর দিন।