২০০১ সালকে আমরা যেন না ভুলি। ওই সময় নতুন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসার পরপরই কিছু অতি উৎসাহী ক্রীড়া সংগঠক তাঁদের অতীত বঞ্চনা পূরণ করার জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নির্বাচিত কমিটিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য নির্বাহী বিভাগকে সফলভাবে প্ররোচিত করেন, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়। ফুটবলের আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিফা বাফুফের সদস্য পদ বাতিল করে দেয়। পরে নাকে খত দিয়ে পুরোনো কমিটিকে পুনর্বহাল করতে হয়।
ফিফা, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও ডজন ডজন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ফেডারেশন, যাদের সঙ্গে আমাদের দেশের প্রায় চার ডজন জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন অধিভুক্ত বা যাদের সদস্য, কোথাও সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। এমনকি দেশের আদালতেরও তাতে মাথা-ঘামানোর সংস্থান নেই। এ জন্য আছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোর্ট অব আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টস, সংক্ষেপে সিএএস। ক্রীড়াবিরোধ মেটাতে সবাইকে তারই দ্বারস্থ হতে হয়।
শুধু ২০০১-এর বাংলাদেশই নয়, অন্যান্য দেশও এ জাতীয় নিষেধাজ্ঞার বলি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড নভেম্বর ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ক্রিকেট বোর্ডকে পুনর্গঠন করতে গিয়ে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে। একই কারণে জিম্বাবুয়েও নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিল ২০১৯-এর জুলাই-অক্টোবর সময়ের জন্য। ফুটবলে আফ্রিকার একাধিক দেশের এই নিষেধাজ্ঞা মিলেছে।
খেলাধুলায় সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতেই এই সব নিয়মকানুন। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক পটপরিবর্তন কমপক্ষে ১৫ বছরের জমা বঞ্চনার ক্ষোভকে সামনে নিয়ে এসেছে। তার বহিঃপ্রকাশও যে খুব পরিশীলিত হবে, এমন নয়। কিন্তু আমাদের পরিশীলিত পথেই যেতে হবে। এরই মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফেডারেশন বা বোর্ড নিয়ে কিছু বঞ্চিত সংগঠক সচল হয়ে উঠেছেন। বাফুফে আর ক্রিকেট বোর্ডের মাথায় যে দুজন আছেন এবং তাঁদের পুরো কমিটিই সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত ও যোগ্য বলেই বিবেচিত। প্রথমটির মেয়াদ এই বছরের শেষাবধি, পরেরটি আগামী বছর। সুতরাং কেউ পছন্দ করুন বা না করুন, এই কমিটি দুটিকে তাদের মেয়াদ শেষ করতে দেওয়াই বাঞ্ছনীয় হবে। অন্যথায় যেকোনো সরকারি হস্তক্ষেপ ২০০১ সনের দৃশ্যপট তৈরি করবে।
শুধু এ দুটি সংস্থাই নয়, বাকি সব কটি ফেডারেশনকেই তাদের মেয়াদ শেষ করতে দিতে হবে। প্রত্যেককেই মেয়াদ শেষে জেনারেল কাউন্সিলরদের ডেকে নতুন নির্বাচন বোর্ড তৈরি করে নতুন নির্বাচন ডাকতে হবে। আর এতেই একটা ইঙ্গিত দেওয়া যাবে বাকি দুনিয়াকে যে একটা আপাত ওলট-পালটের পরও বাংলাদেশ সুস্থ মাথায় সব সমস্যার সমাধানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি।
কবি ও সাংবাদিক সাজ্জাদ শরিফ সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে এক ‘বিশেষ সম্পাদকীয়’তে লিখেছেন, ‘আমাদের হাতে এখন একটি সফল আন্দোলনের পতাকা উড়ছে। আমরা যেন একে ঠিকভাবে বহন করে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।’ এ দেশের তরুণেরা আসলেই একাত্তর থেকে শুরু করে পতাকা উত্তোলন ও বহনের দায়িত্বে এগিয়ে এসেছেন।
তাঁদেরই প্রজন্মের একজন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। সংস্কার এই প্রজন্মের অন্যতম স্লোগান। একটা বহুপ্রতীক্ষিত সংস্কার করে যেতে পারেন ক্রীড়ার এই নতুন অভিভাবক, আর তা হলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইনের ২০(ক) ধারাটি বাতিলকরণ। এই ধারা মূল বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদ আইন ১৯৭৪-এ ছিল না। ১৯৭৬ সালে নতুন চেয়ারম্যান জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোকে নতুন নামাঙ্কিত ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এই ধারা চালু করেন। স্বাধীন ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ধারাটির প্রত্যাহার প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ফেডারেশন অথবা আইওসি যদি জানতেও পারে যে বাংলাদেশে সরকারি আইনে এমন একটা বিধান রয়েছে, তাহলে অমঙ্গলের আশঙ্কা আছে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশেই এই কাজ করা সম্ভব; তা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের জন্য রেখে দেওয়া ঠিক হবে না, কারণ, তাঁরা প্রায় পাঁচ দশকেও সে কাজটি করেননি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।