শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২৩। কেমন ছিল খেলার এই বছর? ধারাবাহিক বর্ষপরিক্রমায় আজ ফিরে দেখা যাক বাংলাদেশের অন্যান্য খেলা।
অ্যাথলেটিকস, হকি, দাবা, কাবাডি—খেলাগুলোতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের বড় অর্জন বলতে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে এশিয়ার গণ্ডিতে ইমরানুর রহমানের আলো ছড়ানো। এশিয়াডে কোনো রকমে মান বাঁচিয়েছে ক্রিকেটে ছেলে ও মেয়েদের ব্রোঞ্জ জয়। এশিয়ান আর্চারিতে হাকিম ও দিয়া এনে দিয়েছেন সোনা।
অ্যাথলেটিকসে কখনো এশীয় স্তরে সোনা জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে সেই অধরা সোনা এসেছে দেশের দ্রুততম মানব ইমরানুর রহমানের হাত ধরে। ফেব্রুয়ারিতে কাজাখস্তানে এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে ইতিহাস গড়েন ইংল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই অ্যাথলেট। হিটে ৬.৭০ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হয়ে ওঠেন সেমিফাইনালে। ফাইনালে করেছেন ক্যারিয়ার-সেরা টাইমিং ৬.৫৯ সেকেন্ড।
ফেব্রুয়ারিতে কাজাখস্তানে এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে ইতিহাস গড়েন দেশের দ্রুততম মানব ইমরানুর।
ইমরানুর আলো কেড়েছেন বিশ্বমঞ্চেও। আগস্টে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিটে প্রথম হয়েছিলেন। যদিও ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ১০.৫০ সেকেন্ড সময় নেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে ১০.৪১ টাইমিং করেও সেমিতে উঠতে পারেননি। ইমরানুরের পাশে বুদাপেস্টে হিটে দৌড়েছিলেন অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনাজয়ী ইতালির মার্চেল ইয়াকব। পরের মাসেই অবশ্য হাংজু এশিয়াডে ১০.৪৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের সেমিতে উঠেছিলেন বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের মুখ হয়ে ওঠা ইমরানুর।
গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালেও আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের আর্চারি। মার্চে থাইল্যান্ডের ফুকেটে এশিয়ান আর্চারিতে রিকার্ভের মিশ্র দলগত ইভেন্টে হাকিম আহমেদের সঙ্গে জুটি বেঁধে সোনা জেতেন দিয়া সিদ্দিকী। এ বছর আর্চারির সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল এটিই। এই প্রতিযোগিতায় এসেছে আরও তিন পদক। রিকার্ভের দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছে ছেলে, মেয়ে—দুই দলই।
মার্চে থাইল্যান্ডের ফুকেটে এশিয়ান আর্চারিতে রিকার্ভের মিশ্র দলগত ইভেন্টে হাকিম আহমেদের সঙ্গে জুটি বেঁধে সোনা জেতেন দিয়া সিদ্দিকী। এ বছরই আবার নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর্চারিতে ফিরেছেন রোমান সানা।
নাসরিন, বিউটি, দিয়াদের সঙ্গে দেশকে পদকের সাফল্য এনে দিয়েছেন রামকৃষ্ণ সাহা, রোমান সানা আর আহমেদ রুবেল। হাকিম জিতেছেন ব্যক্তিগত ব্রোঞ্জও। আর্চারিতে পদকের সম্ভাবনা জেগেছিল এশিয়ান গেমসেও। ছেলেদের রিকার্ভ দলগত ইভেন্টের সেমিফাইনালে ভারত আর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী লড়াইয়ে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে হেরে সেটি হয়নি। রোমান সানা, হাকিম আহমেদ, সাগর ইসলামরা আসল লড়াইয়েই হয়েছেন ব্যর্থ।
আর্চারি এ বছর ফিরে পেয়েছে তাদের সবচেয়ে বড় তারকা রোমানকে। ২০২২ সালের নভেম্বরে এক অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। ক্ষমা চেয়ে এ নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়েছেন। মার্চে ফিরে স্বাধীনতা দিবস আর্চারিতে সোনা জেতেন। এ বছর জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটিও ঘটেছে রোমানের। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন আর্চারির সতীর্থ দিয়াকে। প্রেমের পরিণতিই দিয়েছেন রোমান-দিয়া জুটি। বিয়ের পর এশিয়াডে দিয়া-রোমান ব্যক্তিগত ইভেন্টে অবশ্য বলার মতো কিছু করতে পারেননি।
তবে এশিয়াডে আশা জাগান বক্সার সেলিম হোসেন। সেনাবাহিনীর এই খেলোয়াড় শ্রীলঙ্কা ও তাজিকিস্তানের প্রতিযোগীকে হারিয়ে পদকের লড়াইয়ে পৌঁছে যান। যদিও শেষ পর্যন্ত জাপানের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে শেষ হয়েছে তাঁর অভিযান।
বক্সার সেলিম বাদে এশিয়াডে ব্যক্তিগত ইভেন্টে তেমন আলো কাড়তে পারেননি কেউ। ভরাডুবি হয়েছে প্রায় সব খেলাতেই। হকি গতবারের ষষ্ঠ স্থান হারিয়ে এবার অষ্টম। ভারতের কাছে হকি দলের হার ১২-০ ব্যবধানে। দেশের হকি এখন পুরোপুরিই আন্তর্জাতিক ম্যাচনির্ভর হয়ে পড়েছে। বছরে জাতীয় দল, বয়সভিত্তিক কয়েকটি দল বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলেছে। জুনিয়র এএইচএফ কাপ হকিতে গ্রুপসেরা হয়ে জুনিয়র এশিয়া কাপে জায়গা করে নিয়েছিল অনূর্ধ্ব-২১ দল। লঙ্কানদের বিপক্ষে জয়টা ছিল ১৪-০ গোলের। তবে চূড়ান্ত পর্বে জুটেছে ষষ্ঠ স্থান। তবে এশিয়াডে মান বাঁচিয়েছে ক্রিকেট। প্রথমে পাকিস্তানকে হারিয়ে মেয়েরা উপহার দেন ব্রোঞ্জ। পরে ছেলেদের ক্রিকেট দলও পাকিস্তানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছে। হাংজুতে বাংলাদেশের অর্জন এই দুটি ব্রোঞ্জই।
ঘরোয়া হকিতে ছিল হাহাকার, প্রিমিয়ার লিগ হয়নি এ বছরও। গত পাঁচ বছরে লিগ হয়েছে মাত্র একটি।
ঘরোয়া হকি নিয়ে চলছে হাহাকার। গত পাঁচ বছরে লিগ হয়েছে মাত্র একটি। ২০২১ সালে হয়েছে সর্বশেষ লিগ। দেশের তৃতীয় প্রধান খেলা হয়েও হকির ঘরোয়া আয়োজন সবচেয়ে অনিয়মিত। কোনো বর্ষপঞ্জি দিতে পারেনি এই খেলা। অভিযোগ আছে, হকি ক্লাবগুলোই নাকি লিগ খেলতে চায় না। হতাশার চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গেছেন এই খেলার খেলোয়াড়েরা।
হাংজুতে এশিয়াডে পাকিস্তানকে হারিয়ে নারী, পুরুষ—দুই ইভেন্টেই ব্রোঞ্জ জিতেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
জাতীয় খেলা কাবাডির অবস্থাও খুব ভালো ছিল না এ বছর। ২০১০ সালের পর থেকে এশিয়ান গেমসে পদক নেই এই খেলায়। এবার হাংজুতেও একই ফল। পদকের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তুহিন তরফদাররা ফিরেছেন শূন্য হাতে। নারী কাবাডি দল নেপালের কাছেও হেরে পাঁচ দলের মধ্যে চতুর্থ হয়েছে। ঘরোয়া লিগ অনিয়মিত। যদিও বছরের শুরুতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কাবাডি আয়োজিত হয়েছে। এই টুর্নামেন্টেও ফাইনালে হারতে হয়েছে নেপালের কাছে। ভলিবল কোর্টে কাবাডির আয়োজনও বিতর্ক তৈরি করেছিল বঙ্গবন্ধু কাবাডির সময়।
বছরজুড়ে শুটিংয়ের ব্যর্থতা চোখে লেগেছে। এশিয়ান গেমসে কোনো ইভেন্টেই ফাইনালের আশপাশেও যেতে পারেননি আবদুল্লাহ হেল বাকিরা। জাতীয় শুটিংয়ে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনাজয়ী অর্ণব শারার দিল্লিতে বিশ্বকাপ শুটিংয়ে সেই পারফরম্যান্সও ধরে রাখতে পারেননি। জাতীয় শুটিংয়ে ৬২৮.৭ স্কোর করা অর্ণব বিশ্বকাপে স্কোর করেছিলেন ৬২৩.২। ৩৫ শুটারের মধ্যে তিনি হয়েছেন ২৬তম।
দাবায় বছরজুড়েই ছিল ফাহাদ রহমানকে নিয়ে হাহাকার। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার পর থেকেই গ্র্যান্ডমাস্টার নর্মের জন্য খেলে যাচ্ছেন একের পর এক টুর্নামেন্ট। এ বছর গোটা চারেক টুর্নামেন্ট নর্মের খুব কাছে গিয়েও স্নায়ুচাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত আর পারেননি। তীরে এসে তরি ডুবছে। শেখ কামাল যুব গেমস দিয়ে শুরু হয়েছিল বছরটা। অনূর্ধ্ব-১৭ বছর বয়সী ক্রীড়াবিদদের নিয়ে বেশ বড় পরিসরেই হয়েছে এর আয়োজন। উপজেলা ও জেলা পর্যায় থেকে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন ধাপে আয়োজিত এই গেমসে ২৪ খেলায় অংশ নিয়েছিলেন ২৫ হাজারের বেশি প্রতিযোগী
কিন্তু এমন সুন্দর একটা আয়োজনেও অভিযোগ উঠেছিল বেশি বয়সীদের মাঠে নামানোর। কুস্তিতে এ নিয়ে হয়েছে তুলকালাম। দেশের অন্যান্য খেলার পদ্ধতিগত সমস্যার একটা চিত্রই যেন এটি। অনেক ‘নেই’ আর অভিযোগের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে এই খেলাগুলো। সাঁতার, ভারোত্তোলনের মতো খেলাগুলোর সঙ্গী সেই হতাশাই।