ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। পরশু হকি, অ্যাথলেটিকস, দাবা, কাবাডি, ব্রিজ, স্কোয়াশ, টেনিস, বিলিয়ার্ড অ্যান্ড স্নুকার ও বাস্কেটবল—এই নয়টি অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কমিটির সদস্যসংখ্যা ১৪ থেকে ১৯ পর্যন্ত। কেমন হলো নতুন নেতৃত্ব?
সাবেক সচিব সৈয়দ সুজাউদ্দিন আহমেদ হয়েছেন দাবা ফেডারেশনের সভাপতি। দাবা ফেডারেশনের সদস্য, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের চারজনই হয়েছেন সুজাউদ্দিন দাবা ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন।
তবে ৭৭ বছর বয়সে তাঁকে এই দায়িত্বে আনা ঠিক হয়নি বলছেন উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, ‘অতীতে দেখেছি তিনি খেলোয়াড়দের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেন। এখন তিনি অবসরপ্রাপ্ত, ক্ষমতাহীন। এ কারণেই আমি, রানী আপা সার্চ কমিটিকে বলেছিলাম সুজা ভাইকে সভাপতি না করতে। কিন্তু তাঁকেই করা হয়েছে। সুজা ভাই যে কমিটি দিয়েছেন, সেটাই পাস হয়েছে। তাহলে সংস্কারটা কোথায় হলো? যা হয়েছে, আমি বলব প্রহসন।’
এদিকে নিয়াজের অভিযোগ সঠিক নয় বলেছেন সুজাউদ্দিন। তিনি বলেন, তিনি কোনো কমিটি দেননি। তবে গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব কমিটি নিয়ে খুশি, ‘যেমন কমিটি চেয়েছিলাম, তেমনই হয়েছে।’ আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিলের অবশ্য ভিন্নমত, ‘কমিটির অনেককেই চিনি না, তাঁরা দাবার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাঁদের কেন আনা হলো, কে আনল, কিছুই বুঝলাম না।’
নাজনিন ইসলামের নাম উল্লেখ করে নিয়াজ বলেন, ‘এই নামের একজনকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে। তাঁর নামের পাশে লেখা চেয়ারম্যান রিয়ান মনি সোসাইটি, দাবা অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক। তাঁকে কখনো দেখিনি, চিনিও না। কোষাধ্যক্ষ সম্পর্কেও জানি না।’
সভাপতি সুজাউদ্দিনও প্রথম আলোকে বলেছেন, নাজনিন ইসলামসহ কমিটির পাঁচজনকে তিনিও চেনেন না। নাজনিনের নাম সার্চ কমিটির তালিকায় ছিল না বলে জানিয়েছেন কমিটির এক সদস্য।
অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে ফিরেছেন শাহ আলম। অতীতে দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠেছিল। তবে সাবেক অ্যাথলেট শাহ আলম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক বলেছেন।
অ্যাথলেটিকসের কমিটি নিয়ে আছে নানা অসন্তোষ। সহসভাপতি ইকবাল হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান, কিতাব আলীসহ কয়েকজনকে নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। কোষাধ্যক্ষ ড. সাব্বির আহমেদ খান সেভাবে পরিচিত নন।
মজার ব্যাপার, অ্যাথলেটিকসে দুই ভাইকে সদস্য করা হয়েছে। মজিবুর রহমান মল্লিক ও এম এম নজির আহমেদ। সার্চ কমিটির তালিকায় নাকি নজিরের নাম ছিল না।
১৯ সদস্যের অ্যাথলেটিকসের কমিটিতে সদস্য করা হয়েছে দেশের বর্তমান দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারকে, যা কিনা নজিরবিহীন। তাঁকে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে রাখা হয়েছে। ব্রিজে বুয়েটের একজন, বাস্কেটবলেও আছেন একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি। শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বাকিগুলোতে নেই কেন, প্রশ্ন আসছে।
ফেডারেশনগুলোর কমিটিতে বেশ কিছু অচেনা মুখ আছে। হকির সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল হাসানকে এ অঙ্গনের অনেকেই দেখেননি। জাতীয় হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ মামুন উর রশিদ যেমন বলেছেন, ‘তাঁর নাম আগে কখনো শুনিনি, ওনাকে দেখিওনি।’
রিয়াজুল সেনা নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। একসময় হকি খেলেছেন। হকির এই কমিটিতে ক্লাব-জেলার প্রতিনিধিত্ব সেভাবে নেই। মোহামেডান, ঊষার কেউ জায়গা পাননি। ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব না থাকলে ক্লাব খেলতে আগ্রহী হবে কি না, প্রশ্ন তুলছেন হকি সংশ্লিষ্টরাই।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কাবাডি ফেডারেশন ছিল ‘পুলিশ ফেডারেশন’। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও একজন যুগ্ম সম্পাদক তিনজনই ছিলেন পুলিশ। নতুন কমিটিতে তিনজনের দুজন পুলিশ। সভাপতি পদে বরাবরের মতো আইজিপিই। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বিদায়ী কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নেওয়াজ সোহাগ। কাবাডির সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা বেশি দিনের নয়। বিদায়ী কমিটির যুগ্ম সম্পাদক অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক অ্যাডহক কমিটিতেও একই পদে আছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সংগঠক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘কাবাডিতে সংস্কারের নামে আসলে কিছুই হয়নি।’
সার্চ কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, তাঁরা যে নামগুলো সরকারকে প্রস্তাব করেছেন, তা থেকে ৮০ ভাগ রাখা হয়েছে। ২০ ভাগ যোগ-বিয়োগ করেছে সরকার। সূত্র জানিয়েছে, সার্চ কমিটির দেওয়া ব্রিজ ও কাবাডির সভাপতি বদল হয়েছে। সার্চ কমিটির প্রস্তাবনা থেকে একজন সাধারণ সম্পাদক বাদ পড়েছেন। কিছু নাম মন্ত্রণালয় সংযোজন করেছে। শেষ দিকে অনেক নাটকীয়তা, তদবির হয়েছে বলে জানা গেছে।
অ্যাডহক কমিটির প্রজ্ঞাপনে এনএসসি এত দিন জানিয়ে দিত, তিন মাস বা ‘যথাশীগ্রই সম্ভব’ নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু ঘোষিত ৯টি ফেডারেশনের প্রজ্ঞাপনে তেমন কথাই নেই। নতুন নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত সম্ভবত অ্যাডহক কমিটিই ফেডারেশন চালাবে। ফেডারেশনের নির্বাচনে ভোটার হয় ঢাকার ক্লাব, বিভিন্ন সংস্থা ও জেলা।
কিন্তু ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক বদলের পর জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো সরকার ভেঙে দিয়েছে। জেলা ক্রীড়া সংস্থা গঠিত হওয়ার পর জেলা থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি আসবে ফেডারেশনের নির্বাচনে ভোট দিতে বা প্রার্থী হতে। প্রক্রিয়াটা সময় সাপেক্ষই মনে হচ্ছে। ফলে অ্যাডহক কমিটি ঠিক কত দিন থাকবে, কবে নির্বাচিত কমিটি আসবে, বলা ভীষণ কঠিন।