‘সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম বীরত্বেরও ঘাড়ে একদিন মৃত্যুর থাপ্পড় পড়ে/ সবচেয়ে রক্তপায়ী তলোয়ারও ভাঙে মরচে লেগে’—কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার এ লাইনগুলো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পড়ার কথা নয়। পূর্ণেন্দু পত্রীর এ লাইনগুলো কেউ যদি ইংরেজি বা পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করে না–ও থাকেন, তাতেই–বা কী! এটা তো অমোঘ সত্য। ইংরেজি বা পর্তুগিজে এমন সত্যবাণী কি আর নেই! এ সত্য কথাটা কেউ কি তাঁকে কখনো বলেনি!
পূর্ণেন্দু পত্রীও অবশ্য পড়ার দরকার নেই রোনালদোর। ইংরেজ কবি জন কিটসও তো লিখে গেছেন, তারুণ্যও একটা সময় বিবর্ণ হয়, মরে যায়। তিনিই আবার লিখেছেন, ‘চরম সৌন্দর্যও চিরকাল ধরে রাখা যায় না।’ এগুলো কি কখনো কারও কাছে শোনেননি রোনালদো, নাকি শুনলেও তিনি মানেন না? প্রশ্নটা এ কারণেই করা, গোটা ফুটবল–বিশ্ব যখন আন্তর্জাতিক ফুটবলে রোনালদোর এপিটাফ লিখে বসে আছে, গাইছে বিদায়ের বেহাগ; ৪০ ছুঁই ছুঁই রোনালদো কেন গোঁ ধরে বসে আছেন—আমি যাব না!
পর্তুগাল দলের জন্য এবারের ইউরোতে তাঁর ইমপ্যাক্ট কী? ৫ ম্যাচে কোনো গোল নেই, একটি মাত্র অ্যাসিস্ট। সবচেয়ে বেশি ৬টি ইউরো খেলার রেকর্ড গড়া রোনালদো একমাত্র এবারই ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের এ টুর্নামেন্টে ছিলেন গোলহীন। আসলে বড় টুর্নামেন্টে সর্বশেষ খেলা ১১টি নকআউট ম্যাচে মাত্র ১টি গোলই করেছেন রোনালদো।
‘আমি যাব না’ কথাটি রোনালদো মুখে বলছেন না। কিন্তু এ–ও তো বলছেন না—বিদায় বন্ধু, এল বিদায়ের ক্ষণ! এবারের ইউরো তো তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে বাস্তবতা বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে তুমি আর দিগ্বিদিক ছোটা চব্বিশ-পঁচিশের যুবকটি নেই। হ্যাঁ, একটা সময় ছিল সব সাফল্য আর রেকর্ড এসে রোনালদোর পায়ে লুটিয়েছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোল, ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ গোল, ইউরোরর সর্বোচ্চ গোল, আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোল, পেশাদার ফুটবলে সর্বোচ্চ গোল—পৃথিবীর তাবৎ গোলের রেকর্ড এসে তাঁর পায়ের কাছে প্রবল নৃত্যরত এখনো!
তাহলে? এত অর্জন আর সাফল্যের পরও কি ক্ষুধা মেটেনি রোনালদোর! নাকি তিনি ভয় পাচ্ছেন, নতুন কেউ এসে যদি রেকর্ডটা ছিনিয়ে নেয়। তাই আরও কিছুদিন সিংহাসনে থেকে রেকর্ডটাকে যতটা বড় করা যায়—এই ভীমরতিপ্রাপ্তরাই বুঝি হয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। কিন্তু ওই যে বলা হলো—কানের কাছে ফিসফিস করে নয়, এবারের ইউরোটা তাঁকে চিৎকার করেই বলে গেল—তুমি বুড়ো হয়ে গেছ, তোমার সময় শেষ; এবার বিদায় বলে চলে যাও।
পাঁচটি ম্যাচ—এবারের ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে যাওয়া পর্তুগাল এ কয়টি ম্যাচই খেলেছে। ভরা ৩৯–এও রোনালদো এই ৫ ম্যাচেরই শুরুর একাদশে খেলেছেন। কিন্তু পর্তুগাল দলের জন্য এবারের ইউরোতে তাঁর ইমপ্যাক্ট কী? ৫ ম্যাচে কোনো গোল নেই, একটি মাত্র অ্যাসিস্ট। সবচেয়ে বেশি ৬টি ইউরো খেলার রেকর্ড গড়া রোনালদো একমাত্র এবারই ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের এ টুর্নামেন্টে ছিলেন গোলহীন। আসলে বড় টুর্নামেন্টে সর্বশেষ খেলা ১১টি নকআউট ম্যাচে মাত্র ১টি গোলই করেছেন রোনালদো।
পাঁচটি ম্যাচেই শুরুর একাদশে খেললেও আগের সেই গতি আর ক্ষিপ্রতা রোনালদোর মধ্যে ছিল অনপুস্থিত। একাধিক গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রায় সব ম্যাচেই। ফ্রান্সের কাছে টাইব্রেকারে হেরে যাওয়া কোয়ার্টার ফাইনালে তো একবার নিজের পজিশন থেকে সরে নিচে নেমে যাওয়ার পর আবার সেখানে ফিরে যেতে ২ মিনিট সময় নিয়েছেন। এই ম্যাচেই টাইব্রেকারের সময় একটি দৃষ্টিকটু কাজই করেছেন রোনালদো
টাইব্রেকারে জোয়াও ফেলিক্স গোল করতে ব্যর্থ হওয়ার পর সব সতীর্থই তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। রোনালদো সেই সময় একা হেঁটে হেঁটে ক্যামেরা খুঁছিলেন। বারবার ক্যামেরার সামনে ঘুরে যাচ্ছিলেন। এটা দেখে অজান্তে অনেকেরই মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে একটা কথা—আহারে সময়, আহারে রোনালদো! একটা সময় ছিল ক্যামেরাই রোনালদোকে খুঁজে নিত, আর এখন তাঁকেই খুঁজতে হয় ক্যামেরা! এরপরও কি রোনালদো বলবেন—আমি যাব না
রোনালদোর হয়তো মনে হচ্ছে, সব পাওয়ার পরও মানুষের তবু বাকি থাকে কোনোখানে একটি চুম্বন। সেই চুম্বনটি তো পাওয়া হলো না, তাহলে কেন যাব! লিওনেল মেসি যেমন সেই ‘চুম্বন’টি পেয়ে গেছেন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ জিতে। কিন্তু রোনালদোর তো এখনো সেটি পাওয়া হয়নি। ২০১৬ সালের ইউরোর শিরোপা জিতেছেন, বিশ্বকাপ তো জেতা হয়নি। তাহলে কি...। ইউরোর পর অবসরের ঘোষণা না দেওয়ায় প্রশ্নটা অনেকেই করছেন, তাহলে কি ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলবেন রোনালদো?
কিন্তু ওই যে লেখার শুরুতেই বলা হলো—‘সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম বীরত্বেরও ঘাড়ে একদিন মৃত্যুর থাপ্পড় পড়ে/ সবচেয়ে রক্তপায়ী তলোয়ারও ভাঙে মরচে লেগে’
রোনালদোর এটা মানতে হবে। কথাগুলো কেউ কখনো তাঁকে না বললেও এবারের ইউরোতে তিনি নিজেই হয়তো চিরন্তন এ সত্যকে অনুধাবন করতে পেরেছেন। হয়তো শিগগিরই তিনি বুঝতে পারবেন—সময় এসে গেছে। বলবেন, ‘এবার বিদায় প্রিয় ফুটবল!’