রাজা জোকোভিচ, অবিশ্বাস্য ভেরস্টাপেন ও লাইলসের আগমন

শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২৩। কেমন ছিল খেলার এই বছর? ধারাবাহিক বর্ষপরিক্রমায় আজ ফিরে দেখা যাক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও অন্যান্য।

‘কোর্টে যখন আসল নোভাক জোকোভিচের দেখা মেলে, তখন তার সঙ্গে পেরে ওঠার সাধ্য কার’—গত মাসেই কথাটা বলেছেন নোভাক জোকোভিচের কোচ গোরান ইভানিসেভিচ।

২০০১ সালে ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে উইম্বলডন জিতে ইতিহাস গড়া ইভানিসেভিচের সঙ্গে দ্বিমত করার উপায় নেই! পুরো ক্যারিয়ারের কথা না হয় নাই বলা হলো, জোকোভিচ এক ২০২৩ সালেই যা করেছেন, সেটিই যথেষ্ট ইভানিসেভিচের কথার যথার্থতা প্রমাণে।

৩৬তম জন্মদিনটা ২০২৩ সালেই উদ্‌যাপন করেছেন সার্বিয়ান তারকা। আর এই বয়সেই কিনা পুরো বছরে ৬৩টি ম্যাচ খেলে ৫৬টিতেই জিতেছেন। শিরোপাও জিতেছেন সবার চেয়ে বেশি—সাতটি।

গ্র্যান্ড স্লামের এককে ২৩তম শিরোপা জয়ের পর নোভাক জোকোভিচ

আর এ বছরেই তো অন্তত সংখ্যায় হলেও সর্বকালের সেরা পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়ের তকমাটা নিজের করে নিয়েছেন জোকোভিচ। গ্র্যান্ড স্লাম ক্যারিয়ারের ২২, ২৩ আর ২৪ নম্বর একক শিরোপাটা এবারই জিতে একের পর এক রেকর্ড গড়েছেন। অথচ ২০২২ সালটা কী যন্ত্রণারই না ছিল জোকোভিচের। করোনার টিকা না নেওয়ায় খেলতেই পারেননি অস্ট্রেলিয়ান ও ইউএস ওপেনে। অস্ট্রেলিয়া থেকে তো তাঁকে অপদস্থ করেই বের করে দেওয়া হয়েছিল।

খুবই বিশেষ একটা মৌসুম কাটল, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই যে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মৌসুম কাটালাম।’
নোভাক জোকোভিচ, সার্বিয়ান টেনিস তারকা

সেই জোকোভিচ মেলবোর্নে ফিরেই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে ছুঁয়েছেন ছেলেদের টেনিসে রাফায়েল নাদালের সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম একক জয়ের রেকর্ড (২২)। এরপর প্যারিসে ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে রেকর্ডটাকে একান্তই নিজের করে নিয়েছেন। আর নিউইয়র্কে বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্লামটি জিতে নারী-পুরুষ মিলিয়েই সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের রেকর্ডে মার্গারেট কোর্টের পাশে বসেছেন জোকোভিচ।

রেকর্ড আরও আছে। তুরিনে বছর শেষের মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট এটিপি ফাইনালস জিতেও রেকর্ড গড়েছেন জোকোভিচ। সপ্তম শিরোপা জিতে কেড়েছেন রজার ফেদেরারের রেকর্ড। অবিশ্বাস্য এক বছর কাটানোর পুরস্কারটা র‌্যাঙ্কিংয়েও পেয়েছেন। অষ্টমবারের মতো এটিপি র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থেকে বছর শেষ করে নিজের রেকর্ডটাকে আরেকটু উঁচুতে তুলেছেন। ২০২১ সালেই সপ্তমবারের মতো শীর্ষে থেকে বছর শেষ করে এই রেকর্ডে শৈশবের নায়ক পিট সাম্প্রাসের রেকর্ড ভেঙেছিলেন জোকোভিচ।

এবারসহ মোট চারবার এক বছরে তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছেন নোভাক জোকোভিচ। আরও কারও তিনবারের বেশি নেই এই কীর্তি।

জোকোভিচের নিজের কাছেও ২০২৩ সালটা ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বছর, ‘খুবই বিশেষ একটা মৌসুম কাটল, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই যে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মৌসুম কাটালাম।’

তুরিনে এটিপি ফাইনালস জয়ের পর জোকোভিচ ব্যাখ্যা দিয়েছেন কীভাবে এই বয়সেও রাজত্ব করে চলেছেন সেটির, ‘রোলাঁ-গারোতে (রেকর্ড) ২৩তম গ্র্যান্ড স্লাম জয়টাই বাঁকবদলের মুহূর্ত হয়ে আছে। এমন একটা অর্জনই বছরের বাকি সময়টায় আমাকে ডানা মেলে উড়ে চলার শক্তি জুগিয়েছে।’

কতটা শক্তি জুগিয়েছে সেটির প্রমাণ তো পাঁচ সেটের ম্যাচগুলো। জোকোভিচই যেখানে এক নম্বর। জোকোভিচের পর বছরের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় নিঃসন্দেহে কার্লোস আলকারাজ। যদি জোকোভিচ নামের কেউ না থাকতেন, এটা বলেই দেওয়া যায় বছরটা শুধুই আলকারাজের হতো। জুলাইয়ে তো অল ইংল্যান্ড ক্লাব ক্ল্যাসিক এক ফাইনালে জোকোভিচকে হারিয়ে উইম্বলডন জিতেছিলেন ২০ বছর বয়সী স্প্যানিশ তারকা। টেনিসের নতুন যুগের সূচনাও তখন দেখছিলেন অনেকে। কিন্তু জোকোভিচ যে ভাবছিলেন অন্য রকম!

প্রথম অবাছাই হিসেবে উইম্বলডন জয়ের রেকর্ড গড়েই লন্ডন ছেড়েছেন র‌্যাঙ্কিংয়ের ৪২ নম্বর হিসেবে খেলা ভন্দ্রুসোভা

২০২৩ সালে ছেলেদের বিভাগটা যেখানে নোভাক জোকোভিচের ‘একনায়কতন্ত্র’ দেখেছে, সেখানে মেয়েদের টেনিসটা পুরোপুরিই ‘গণতন্ত্রময়’। বছরের চারটি গ্র্যান্ড স্লাম যে ভাগাভাগি করেছেন চারজন। একাধিক ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতাই ছিল শুধু আরিনা সাবালেঙ্কার। জাতীয় পতাকা নিয়ে খেলতে না পারা বেলারুশ তারকাই জিতেছিলেন বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। এরপর ফ্রেঞ্চ ওপেন ও উইম্বলডন জিতেছেন পোল্যান্ডের ইগা সিওনতেক ও চেক প্রজাতন্ত্রের মারকেতা ভন্দ্রুসোভা।

ভন্দ্রুসোভার উইম্বলডন জয় বিস্ময় হয়েই এসেছে। ২০১৭ সালের পর ডব্লুটিএ ট্যুরে কোনো শিরোপা জিততে ব্যর্থ ভন্দ্রুসোভা উইম্বলডন খেলেছেন অবাছাই হিসেব। প্রথম অবাছাই হিসেবে উইম্বলডন জয়ের রেকর্ড গড়েই লন্ডন ছেড়েছেন র‌্যাঙ্কিংয়ের ৪২ নম্বর হিসেবে খেলা ভন্দ্রুসোভা।

আরিনা সাবালেঙ্কা, মারকেতা ভন্দ্রুসোভা ও কোকো গফ—২০১৮ সালের পর ২০২৩ সালে আবার নতুন তিন গ্র্যান্ড স্লাম চ্যাম্পিয়ন পেল মেয়েদের টেনিস।

বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কোকো গফ। ফাইনালে সাবালেঙ্কার কাছে প্রথম সেট হেরেও শেষ হাসিটা হেসেছেন ১৯ বছর বয়সী মার্কিন তারকাই। ২০১৫ সালে ১৫ বছর বয়সেই উইম্বলডনের শেষ ষোলোতে উঠে হইচই ফেলা গফের হাতে ভবিষ্যতে গ্র্যান্ড স্লাম ট্রফি দেখছিলেন অনেকেই। চার বছর পর সত্যি সত্যিই আঁকা হলো সেই ছবিটা। সেই গফ, এ বছরের উইম্বলডনের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়ার পর থমথমে চেহারায় কোর্ট ছেড়েছিলেন যিনি।

কোন গ্র্যান্ড স্লামে কে চ্যাম্পিয়ন

পুরুষ
অস্ট্রেলিয়ান ওপেন: নোভাক জোকোভিচ, সার্বিয়া
ফ্রেঞ্চ ওপেন নোভাক: জোকোভিচ, সার্বিয়া
উইম্বলডন: কার্লোস আলকারাজ, স্পেন
ইউএস ওপেন: নোভাক জোকোভি, সার্বিয়া


নারী
অস্ট্রেলিয়ান ওপেন: আরিনা সাবালেঙ্কা, বেলারুশ
ফ্রেঞ্চ ওপেন: ইগা সিওনতেক, পোল্যান্ড
উইম্বলডন: মারকেতা ভন্দ্রুসোভা, চেক প্রজাতন্ত্র
ইউএস ওপেন: কোকো গফ, যুক্তরাষ্ট্র

অ্যাথলেটিক ট্র্যাক রাঙানোর মতো একজনকে যে পাওয়া গেছে। সেই একজনের নাম নোয়াহ লাইলস। বিশ্বের নতুন দ্রুততম মানব

লাইলসের আগমন
উসাইন বোল্টের অবসর ব্ল্যাকহোলের মতো গ্রাস করেছিল অ্যাথলেটিকসকে। ২০১৭ সালে সর্বকালের দ্রুততম মানবের অবসরের পর ছয় বছরে অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতাগুলো যেন শুধুই নিয়ম রক্ষার জন্যই হয়েছে। দুটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ গেছে, গেছে একটি অলিম্পিকও। কিন্তু ট্র্যাকে ও ট্রাকের বাইরে ঝড় তোলার মতো কাউকে পাচ্ছিল না অ্যাথলেটিকস।

সেই অবস্থা একটু হলেও বদলেছে ২০২৩ সালে। অ্যাথলেটিক ট্র্যাক রাঙানোর মতো একজনকে যে পাওয়া গেছে। সেই একজনের নাম নোয়াহ লাইলস। বিশ্বের নতুন দ্রুততম মানব। হাঙ্গেরিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দ্রুততম মানবের খেতাব জিতেই থামেননি মার্কিন স্প্রিন্টার। কিংবদন্তি বোল্টের দুটি কীর্তিরও পুনরাবৃত্তি করেছেন।

১০০ মিটার ও ২০০ মিটারের পর ৪x১০০ মিটার রিলের সোনাও জিতেছেন ২৬ বছর বয়সী লাইলস। ২০১৫ সালে বোল্টের পরে প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে এই তিন ইভেন্টের ট্রেবল জিতলেন লাইলস। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটার জয়ের হ্যাটট্রিকটাও বোল্টের পর প্রথম স্প্রিন্টার হিসেবে করেছেন আমুদে এই অ্যাথলেট। লাইলসের চোখ যে এখন প্যারিস অলিম্পিকে ইতিহাস গড়ায়, সেটি না বললেও চলে

উসাইন বোল্টের পর প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০, ২০০ ও ৪*১০০ মিটার স্প্রিন্টের ‘ট্রিপল’ জিতেছেন নোয়াহ লাইলস।

মেয়েদের আথলেটিকসও পেয়েছে নতুন দ্রুততম মানবী। জ্যামাইকান আধিপত্য ভেঙে ১০০ মিটার জিতেছে যুক্তরাষ্ট্রের শা’কারি রিচার্ডসন। সেই রিচার্ডসন যিনি কিনা গাঁজা খেয়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন অ্যাথলেটিকস থেকে

রেকর্ড মানেই ভাঙা-গড়ার খেলা। মাক্স ভেরস্টাপেনের কাছে সেটি যেন ছেলেখেলা

ভেরস্টাপেনের অবিশ্বাস্য কীর্তি
রেকর্ড মানেই ভাঙা-গড়ার খেলা। মাক্স ভেরস্টাপেনের কাছে সেটি যেন ছেলেখেলা। নেদারল্যান্ডসের ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার ২০২৩ সালে যা করেছেন, এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। বছরের ২২টি গ্রাঁ প্রির ১৯টিই জিতেছেন ২৬ বছর বয়সী রেসার। ভেঙেছেন গত বছরই গড়া নিজের ১৫ গ্রাঁ প্রি জয়ের রেকর্ড

যে তিনটি গ্রাঁ প্রি জিততে পারেননি ভেরস্টাপেন, তার দুটিতেও সেরা তিনে ছিলেন। ২২ গ্রাঁ প্রির ২১টিতেই বিজয়-মঞ্চে থাকাটাও তো রেকর্ড। টানা গ্রাঁ প্রি জয়ের রেকর্ডও গড়েছেন ভেরস্টাপেন। মৌসুমে পঞ্চম গ্রাঁ প্রি থেকে ১৪তম গ্রাঁ প্রি পর্যন্ত টানা ১০ বার প্রথম হয়ে সেবাস্তিয়ান ফেট্টেলের রেকর্ড ভেঙেছেন। ২০১৩ সালে টানা নয়টি গ্রাঁ প্রি জিতেছিলেন জার্মান তারকা।

১৯
বছরের ২২টি গ্রাঁ প্রির ১৯টিতেই প্রথম হয়েছেন মাক্স ভেরস্টাপেন।

বছরের শেষ সাতটি গ্রাঁ প্রি জিতে টানা জয়ের নিজের রেকর্ডটাকেই অবশ্য ‘হুমকির মুখে’ ফেলেছেন ভেরস্টাপেন। ২০২৪ সালের প্রথম চারটি গ্রাঁ প্রি জিতলেই যে আবার রেকর্ড। টানা তৃতীয়বার ড্রাইভার্স চ্যাম্পিয়ন জয়ের পথে নিজের দল রেড বুল রেসিংকে ষষ্ঠ কনস্ট্রাকটরস চ্যাম্পিয়নশিপ এনে দিয়েছেন। বছরের ২২ গ্রাঁ প্রির ২১টিতে জিতে রেকর্ড গড়েছে রেড বুলও।