সেই ভরাট কণ্ঠটি আজও কানে ভাসে—‘ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে বলছি আমি খোদা বক্স মৃধা।’
স্যাটেলাইট টেলিভিশনে খেলা সম্প্রচারের এ যুগে গ্যারি আর্মস্ট্রং, অ্যান্ডি গ্রে, টেরি গিবসন কিংবা সুনীল গাভাস্কার, ডেভিড লয়েড, হার্শা ভোগলে, নাসের হুসেইন কিংবা আমাদের আতহার আলী খান, শামীম আশরাফ চৌধুরীদের কণ্ঠ শুনে অভ্যস্ত এ প্রজন্মের খেলাপ্রেমীরা ধারণাও করতে পারবেন না এক খোদা বক্স মৃধার কণ্ঠ এ দেশের কয়েকটি প্রজন্মের মনে কেমন দ্যোতনা সৃষ্টি করত!
ফুটবল বলুন, কিংবা ক্রিকেট, হতে পারে অন্য খেলা—সেগুলো বিটিভি বা বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচার হচ্ছে, আর পর্দার আড়ালে খোদা বক্স মৃধার কণ্ঠ নেই, এমনটা এক সময় ছিল কল্পনারও অতীত। সে সময় দেশের মানুষ খুব বেশি খেলা দেখার সুযোগ পেত না। দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত কোনো খেলা সম্প্রচারিত হলে খোদা বক্স মৃধারাই থাকতেন তার বিশ্লেষক; মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা উপমা দিয়ে সেই খেলাগুলোই উপাদেয় করে তুলতেন এই মানুষগুলো। নিছক খেলার প্রেম থেকেই মাইক্রোফোন হাতে নিতেন তাঁরা। ঢাকা স্টেডিয়াম বা মিরপুর স্টেডিয়ামে কাঠের তৈরি ধারাভাষ্য কক্ষে বসে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ইথারে ছড়িয়ে দিতেন তাদের কণ্ঠ।
সত্তর-আশ কিংবা নব্বইয়ের দশকের সেই দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কয়েকটি নাম। ক্রীড়া ধারাভাষ্যে এই নামগুলোর ছিল তারকাখ্যাতি। তওফিক আজিজ খান, খোদাবক্স মৃধা, নিখিল রঞ্জন দাশ, আবদুল হামিদ, মনজুর হাসান মিন্টু ও মোহাম্মদ মুসা নামগুলো যেন মনোয়ার হোসেন নান্নু, কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন চুন্নু, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, কিংবা মিনহাজুল আবেদীন, আকরাম খান, আমিনুল ইসলামদের মতোই জনপ্রিয় ছিল। দেশের খেলার সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল এ নামগুলো। কখনো আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ, কখনো বা বিদেশি দলকে নিয়ে অনুষ্ঠিত কোনো টুর্নামেন্ট বা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। এই মানুষগুলো মাইক্রোফোনের পেছনে থাকতেনই। এঁদের মধ্যে নিজস্ব একটা স্টাইল দিয়েই সবার মনে আলাদা স্থান তৈরি করেছিলেন খোদা বক্স মৃধা। রাজশাহী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক খোদা বক্স তাঁর বাচনভঙ্গি, ভরাট কণ্ঠ আর ভাষার ব্যবহার দিয়েই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ক্রীড়াপ্রেমীদের। তাঁর মৃত্যুর এক দশক পরেও খেলাপ্রেমীদের বেশ কয়েকটি প্রজন্মের মনে তিনি বেঁচে আছেন অতীতের মধুর নস্টালজিয়া হয়েই।
দশ বছর আগে আজকের দিনেই খোদা বক্স মৃধা চলে গিয়েছিলেন। অসুস্থতা চেপে মৃত্যুর আগ অবধি কাজ করে গিয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সালের শুরুতে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরে তাঁর কণ্ঠ শেষবার শুনেছিল দেশের খেলা পাগল মানুষ। আজ প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে সারা পৃথিবীর বিখ্যাত সব ধারাভাষ্যকাররা আমাদের ড্রয়িং রুমের বাসিন্দা হলেও খোদা বক্স মৃধারা প্রজন্মান্তরে আমাদের আপন মানুষ হয়েই থাকবেন চিরকাল। খোদা বক্স মৃধারাই যে বাংলাদেশের খেলার ইতিহাস।