টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখা একগাদা বই। সবার ওপরে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভের লেখা দাবার বই ‘গ্যারিস্ চয়েস’। রয়েছে মিখাইল মেরিনের ‘দ্য ইংলিশ ওপেনিং’। একপাশে রাখা ল্যাপটপ। সামনে দাবার বোর্ড। ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হোমওয়ার্ক করতে বসে না ফাহাদ রহমান। বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ফিদে মাস্টারের দিনটা শুরু হয় দাবা দিয়ে।
আর আট-দশটা কিশোরের চেয়ে একটু আলাদাই ফাহাদ। অন্যরা যখন স্মার্টফোন, আইপ্যাডে ক্যান্ডি ক্র্যাশ, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস খেলতে ব্যস্ত, ফাহাদ ঘুরে বেড়ায় অনলাইন দাবার বোর্ডে। ল্যাপটপে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নরওয়ের ম্যাগনাস কার্লসেন, সাবেক চ্যাম্পিয়ন ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ, আর্মেনিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার লেভন অ্যারোনিয়ানের লাইভ গেমগুলো দেখে নতুন কোনো চাল শেখার চেষ্টা।
উত্তরার ভাড়া বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমালেও দাবার অনুশীলনের জন্য আলাদা একটা ঘরই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন ফাহাদের বাবা নজরুল ইসলাম। রাজধানীর বারিধারার ক্যামব্রিয়ান স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ফাহাদের দিনমানের বেশিরভাগ সময়ই কাটে দাবার বোর্ডের সামনে।
পাড়ার অন্য ছেলেরা যখন বিকেলে ব্যাট-বল হাতে বাড়ির পাশের মাঠেই দৌড়াদৌড়ি করে, তখন ফাহাদ মগ্ন থাকে কোনো ওপেনিং বিশ্লেষণে। কেন ওদের মতো খেলতে যাও না? ফাহাদের হাসিমাখা উত্তর, ‘আমার ছোটাছুটি করতে ইচ্ছে করে না। দাবার বোর্ডে বসে থাকতেই ভালো লাগে।’
টুর্নামেন্ট বেশি থাকলে অনুশীলনও বেড়ে যায় ফাহাদের। গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট না থাকলেও স্কুল থেকে ফিরে সামান্য বিশ্রামের পরই দাবার বোর্ড নিয়ে বসে। উত্তরায় ফাহাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদের বাড়ি। ফাহাদের বর্তমান কোচ নিয়াজ মোরশেদ আগ্রহ করে বনশ্রী থেকে ফাহাদকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে গেছেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফাহাদ নিয়াজ মোরশেদের কাছে ঘণ্টা তিনেক নিবিড় অনুশীলন করে। গত কয়েক দিন কাজ চলছে মূলত ওপেনিং নিয়ে। ‘নিয়াজ আঙ্কেল মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে খেলেন। তবে বেশির ভাগ সময় শেখান ওপেনিং কী, এটা খেলার উদ্দেশ্য কী?’
স্কুলে কারোর সঙ্গে এখনও গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সবাই ফাহাদকে ভীষণ পছন্দ করে। গল্পের বই দারুণ প্রিয় ফাহাদের। সময় পেলেই বইয়ের তাক থেকে বের করে নেয় জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস। দীপু নাম্বার টু উপন্যাসটা পড়ার পর সিনেমা হলে গিয়েও দেখেছে এই উপন্যাস নিয়ে বানানো সিনেমাটা। যদিও সিনেমা দেখার মোটেও আগ্রহ নেই ফাহাদের। শুধু জাফর ইকবালের উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বলেই নাকি ফাহাদ গিয়েছিল সেটি দেখতে! প্রথম আলোর ম্যাগাজিন কিশোর আলোর একটি অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ফাহাদের। জাফর ইকবাল ভক্ত ফাহাদ জানাল, ‘আঙ্কেল’ আমাকে ভীষণ আদর করেন।’ টেলিভিশনে মাঝে মধ্যে খেলা দেখে ফাহাদ। ক্রিকেটই বেশি।
ইদানীং জাতীয় দলের তরুণ পেসার মুস্তাফিজুর রহমানেরও ভক্ত হয়ে গেছে ফাহাদ। আইপিএলে মুস্তাফিজের খেলা থাকলে কয়েক ঘণ্টা দাবা খেলাটাও বন্ধ রেখে দেয়। মুস্তাফিজকে তোমার কেন এত ভালো লাগে? মুস্তাফিজে রোমাঞ্চিত ফাহাদ বলল, ‘ক্রিকেটে ওর উঠে আসাটা আমার অনেক ভালো লেগেছে। ওর সঙ্গে যেন কোথায় নিজের মিল খুঁজে পাই আমি।’ মনীষীদের জীবনীগুলোও ভীষণ টানে ফাহাদকে, ‘টমাস আলভা এডিসন, স্টিভেন হকিংসের জীবনীগুলো মন দিয়ে পড়ি। ওনারা কীভাবে বড় হয়েছেন, সেগুলো জানার কৌতুহল থেকেই এই বইগুলো পড়ি।’
ছোট্ট ফাহাদের অনুরাগীও জুটে গেছে অনেক। তাকে ঘিরে ক্রিকেটারদের মতো উন্মাদনা নেই, তবে ভালোবাসার ছোঁয়া প্রায়ই পায় ফাহাদ। একবার মায়ের সঙ্গে বাসে করে উত্তরা থেকে ফেডারেশনে খেলতে যাওয়ার সময় বাসে ছিল প্রচন্ড ভিড়। সিট পাচ্ছিল না বসার। কলেজ পড়ুয়া এক তরুণ নিজের সিট ছেড়ে ফাহাদকে বসতে দেয়। সেদিনের ঘটনায় মুগ্ধ ফাহাদ বলছিল, ‘ওই ভাইয়া বললেন, তোমাকে তো আমি টিভিতে অনেক দেখেছি। পেপারেও তোমার ছবি দেখেছি। তুমি দাবাড়ু ফাহাদ! আমার সিটে এসে বসো।’
যানজটের কারণে উত্তরা থেকে পল্টনের ফেডারেশনে যেতে প্রায় ঘন্টা তিনেক সময় লেগে যায়। এত কষ্ট করে নিয়মিত খেলতে যাচ্ছে ফাহাদ। এ নিয়ে একটু ক্ষোভও আছে তার মনে, ‘এখান থেকে যানজট ঠেলে প্রতিদিন খেলতে যাই। কিন্তু যদি ফেডারেশনে থেকে টুর্নামেন্টে খেলতে পারতাম, তাহলে আরও ভালো হতো। কিন্তু আমাকে কেউ রাখতে চায় না ফেডারেশনে।’
মায়ের হাতের রান্না সরষে ইলিশ ভীষণ প্রিয় ফাহাদের। প্রিয় আইসক্রিম। তবে সবচেয়ে প্রিয় সাদা-কালো ঘুঁটিগুলো। তার জীবন যে ওই চৌষট্টি খোপ আর সাদা-কালো ঘুঁটিতেই বাঁধা!