কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ঢাকা পাইনঅ্যাপল বিচ ক্লাব। অ্যান্টিগার মূল শহর সেন্ট জোন্স থেকে আটলান্টিক পারের মনোমুগ্ধকর হোটেলটিতে গাড়িতে যেতে মিনিট চল্লিশেক লাগে।
বাংলাদেশ দলের গত কয়েক দিনের ঠিকানা ছিল এই বিলাসবহুল হোটেল। মঙ্গলবার সকালে পাইনঅ্যাপল বিচ ক্লাব ছেড়ে দল উড়াল দেবে সেন্ট লুসিয়ার উদ্দেশে। ভাড়া করা একই বিমানে তাদের সঙ্গী হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলও।
অ্যান্টিগা টেস্ট চার দিনেই শেষ হয়ে যাওয়ায় কাল টেস্টের ‘পঞ্চম দিন’টা দলের সবারই কেটেছে ছুটির আমেজে। সেন্ট লুসিয়ায় যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছানো ছাড়া তেমন কোনো কাজ ছিল না। অবশ্য ক্রিকেট থেকে অপ্রত্যাশিত এ ছুটির দিনে দলের অনেকে মেতে উঠেছিলেন নতুন এক খেলায়। খেলার নাম শাফলবোর্ড।
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য খেলাটা নতুন হলেও শাফলবোর্ডের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি খেলাটা খেলতেন, এ খেলা নিয়ে বাজিও ধরতেন। খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না বলে এটি বয়স্কদের কাছেই বেশি জনপ্রিয়। বড় বড় ক্রুজ শিপগুলোতে এ খেলার ব্যবস্থা থাকে।
হোটেলের বাগানে বিছানো কংক্রিটের দুটি বোর্ড, দেখতে অনেকটা ক্রিকেটের উইকেটের মতো। বোর্ডের দুই প্রান্তে হলুদ রঙের ত্রিভুজ ছক আঁকা, যার ভেতর ১০, ৮, ৭—এ রকম নম্বর লেখা। ওপেনার তামিম ইকবাল অল্প সময়ের মধ্যেই খেলাটার সুর বেশ ধরে ফেলেছেন বলে মনে হলো। সতীর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ, ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্স সবাইকে বলে বলে হারিয়ে দিচ্ছিলেন।
তামিমের কাছ থেকে শাফলবোর্ড সম্পর্কে যা জানা গেল তা হলো, এ খেলায় শুধু নিজে পয়েন্ট পেলেই জেতা যায় না, জয় নিশ্চিত করতে প্রতিপক্ষের পয়েন্টও নষ্ট করতে হয়। ক্যারম বোর্ডের মতো নিজের ঘুঁটির ধাক্কায় সরিয়ে দিতে হবে অন্যের ঘুঁটিও। এভাবে যে আগে ৫০ পয়েন্ট পাবে, সে জিতবে।
খেলাটাতে তামিমের খ্যাতি পাইনঅ্যাপল বিচ ক্লাবে মোটামুটি ভালোই ছড়িয়েছে। বিশাল হোটেলটির বয়-বেয়ারারাও পাশ দিয়ে যাওয়া-আসার পথে কখনো কখনো দর্শক হন খেলার। তাঁদেরই একজন হাতের ইশারায় তামিমকে দেখিয়ে বলছিলেন, ‘হি ইজ দ্য বেস্ট!’
বিদেশ সফরের হোটেলজীবনে ক্রিকেটাররা সময় কাটানোর অনেক উপায়ই খুঁজে নেন। যেখানে শাফলবোর্ড থাকে না, সেখানে হয়তো টেবিল টেনিস থাকে অথবা অন্য কিছু। অবশ্য ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের যুগে কোনো কিছু না হলেও চলে। অখণ্ড অবসরকেও মুহূর্তে শেষ করে দেওয়ার এ এক অনবদ্য হাতিয়ার। সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আড্ডা-গল্পগুজব তো হয়ই। কাল বিকেলে টিম মিটিংয়ের আগে লিটন, মোসাদ্দেক, মিরাজদের সঙ্গে সে রকমই এক আড্ডা জমে উঠেছিল অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের।
টিম হোটেলের বিচ্ছিন্ন আলোচনায় কান পেতে যে নীরব একটা ফিসফাস টের পাওয়া গেল, শাফলবোর্ডের মতো সেখানেও কেন্দ্রীয় চরিত্র তামিম ইকবাল। টি-টোয়েন্টি দলে না থাকলেও এ সিরিজ শেষ পর্যন্ত খেলে ফেলবেন না তো তামিম!
আলোচনাটা অবশ্য আনুষ্ঠানিক কিছু নয়। তা ছাড়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে তামিমের চলমান ছয় মাসের বিরতি শেষ হতে হতে আগামী জুলাই মাসও প্রায় শেষ হয়ে আসবে। ছুটির মধ্যে পড়ায় ডমিনিকা ও গায়ানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে তাঁর খেলার কথাও নয়। তামিমও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন বলে খবর নেই।
তারপরও টি-টোয়েন্টির আলোচনায় তামিমের থাকার একটাই কারণ—বিসিবির চাওয়া, মন বদলে তামিম সিরিজটা খেলুক। সেন্ট লুসিয়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২৪ জুন শুরু হবে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট। এরপরই বাংলাদেশ দল ডমিনিকায় যাবে টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে। সমুদ্রভীতির কারণে ক্রুজ শিপে সাড়ে ৪ ঘণ্টার সে যাত্রায় দলের সঙ্গী না হয়ে তামিম সেন্ট লুসিয়ায় যেতে পারেন আকাশপথে। তবে টি-টোয়েন্টি যেহেতু খেলবেন না, ওয়ানডে সিরিজের আগপর্যন্ত টি-টোয়েন্টি দলের সঙ্গে থেকেও দলের অনেক কিছুতেই হয়তো থাকা হবে না তাঁর।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে এবারের সফরে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ নেই। অ্যান্টিগায় আসার পথে দোহায় আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়লে দেশে ফিরে যান তিনি। তবে বিসিবির আরেক পরিচালক ওবায়েদ নিজাম ব্যক্তিগত সফরে প্রথম টেস্টের সময়টাতে অ্যান্টিগাতেই ছিলেন। মঙ্গলবার তিনিও ফিরে যাবেন দেশে।
তার আগে কাল আড্ডার মধ্যেই হাসিঠাট্টার ছলে তামিমকে টি-টোয়েন্টি সিরিজটা খেলে ফেলার অনুরোধ করলেন ওবায়েদ নিজাম। আনুষ্ঠানিকভাবে দলের অংশ নন বলে এর বেশি কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভবও নয়। পাশে থাকা ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান তো মজা করে তামিমকে এমনও বললেন, ‘আরে ভাই, ফান ক্রিকেট হিসেবেই খেল না!’ শুনে তামিমের মুখে বিব্রত হাসি—যার অনুবাদ সম্ভবত টি-টোয়েন্টি থেকে নেওয়া বিরতিটা এখনই ভাঙতে চাচ্ছেন না তিনি।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে হিসাব করলে সর্বশেষ ১০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছে শুধু একটিতে, সেটিও গত মার্চে ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে। পরের ম্যাচেই আবার হার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শারজায় মোহাম্মদ নাঈম-লিটন দাসের জুটিতে এসেছিল ৪০ রান। এর বাইরে এই ১০ ম্যাচে আর একটিও ভালো শুরু পাওয়া যায়নি ওপেনিং জুটির কাছ থেকে। ওপেনিং জুটি বদলও হয়েছে কয়েকবার।
সে জন্যই ভেতরে ভেতরে বোর্ডের চাওয়া, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে ২০ ওভারের ক্রিকেটে ফিরুক অভিজ্ঞ তামিম। আর টি-টোয়েন্টি সিরিজটা যেহেতু ওয়ানডে সিরিজের আগে, তামিমকে তো তখনো দলের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজে থাকতেই হবে। তবে ছুটির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে তামিম সে চাওয়া পূরণ করবেন কি না, সেটি এখন পর্যন্ত একান্তই তাঁর ব্যাপার।