আর্জেন্টিনা ১: ০ সুইজারল্যান্ড

আবারও মেসি-ঝলকেই পার আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনা-সুইজারল্যান্ড
আর্জেন্টিনা-সুইজারল্যান্ড

বড় কোনো ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার পরই সাধারণত এমন দেখা যায়। কাল অ্যারেনা করিন্থিয়ানসে সেটির অপেক্ষায় আর থাকলেন না আর্জেন্টিনার অতিরিক্ত খেলোয়াড়েরা। অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ার শটটা গোলে ঢুকতেই বেঞ্চ থেকে ভোঁ-দৌড়। সাবেলা আর কোচিং স্টাফদের দু-একজনই শুধু থাকলেন। বাকি সবাই ঢুকে গেলেন মাঠে। উদ্যাপনটা হলো উল্টো প্রান্তে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে। সে কী উদ্যাপন!
অতিরিক্ত সময় শেষ হতে যখন মাত্র মিনিট দুয়েক বাকি, তখন ম্যাচের একমাত্র গোলটি এলে উদ্যাপন অমনই হওয়ার কথা। দুদিন আগে চিলির বিপক্ষে জিততে টাইব্রেকারে যেতে হয়েছে ব্রাজিলকে। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে সেই লটারি যখন আর্জেন্টিনারও ভবিতব্য বলে মনে হচ্ছে, তখনই ওই গোল। যেটির রূপকার অবশ্যই তিনি।
আগের তিন ম্যাচে চার গোল করেছেন। সেই গোলগুলোও এমন যে, এ যদি বলে আমাকে দেখো, ও বলে আমাকে। কাল কোনো গোল নেই। তার পরও এটি আরও বেশি করে ‘মেসির ম্যাচ’। এই বিশ্বকাপে মেসি সত্যিকার মেসির রূপে দেখা দিলেন তো এই ম্যাচেই। আগের তিন ম্যাচে স্বর্গীয় সব গোল করেছেন ঠিকই, তবে ওই তিনটি ম্যাচের ভিডিও থেকে মেসির গোলগুলো ‘এডিট’ করে কাউকে দেখালে মেসিকে আর দশজন খেলোয়াড়ের চেয়ে আলাদা করে চেনার উপায় থাকবে না। কালকের ম্যাচে সেই সমস্যা নেই। অসংখ্যবার নিজেকে চেনালেন।
এদিন তিনি সত্যিকার প্লে-মেকারের ভূমিকায়। আগের তিন ম্যাচের তুলনায় অনেক বেশি দৌড়ালেন। একজন-দুজন-তিনজনকে অনায়াসে পেছনে ফেলার জাদুও দেখালেন একাধিকবার। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন নির্ধারিত সময় পেরিয়ে অতিরিক্ত সময়ও পেরিয়ে যায় যায়, আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা হয়তো ভাবছিলেন, এসব করে লাভটা কী হচ্ছে! এর চেয়ে আগের তিন ম্যাচের মতো অমন অন্তত একটা গোল করলেই তো হতো।
সেটি করতে না পারলেও আর্জেন্টিনার গোলটা তিনিই করালেন। মাঝমাঠে যখন বলটা পেয়ে গেলেন, সামনে অনেকটা খালি জায়গা। যে বিলাসিতা এর আগে খুব একটা পাননি। সুইজারল্যান্ডের কোচ ওটমার হিটজফেল্ড মেসিকে ঠেকানোর যে মন্ত্র জপে দিয়েছিলেন শিষ্যদের কানে, তা চিন্তায় এমন বৈপ্লবিক কিছু নয়। মেসির পায়ে বল গেলেই যেন আশপাশে কমপক্ষে তিনজন থাকে। তাতে মেসিকে সব সময় আটকানো না গেলেও কখনো কখনো তো গেছেই। স্বভাববিরুদ্ধভাবে মেজাজ হারিয়ে একবার প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে ধাক্কাও দিয়ে বসলেন।
মাঝমাঠে সুইস এক খেলোয়াড়ের কাছ থেকে বলটা কেড়ে নিয়ে তাঁকে দিয়েছিলেন পালাসিও। সেটি পায়ে নিয়ে মেসি অনেকটা ছুটলেন, ট্যাকল-ফ্যাকল অনায়াসে উপেক্ষা করে বক্সের বাইরে থেকে ডান দিকে বলটা দিলেন ডি মারিয়ার পায়ে। ডি মারিয়া এবার আর ভুল করলেন না। দুর্দান্ত এক ম্যাচ খেলা সুইস গোলরক্ষক ডিয়েগো বেনাগলিওকেও শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হলো। ওটমার হিটজফেল্ডের বর্ণাঢ্য কোচিং ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে গেল এই পরাজয়ে। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে মেসিকে নিয়ে বললেন, ‘মেসির মতো খেলোয়াড়েরা এক সেকেন্ডেই একটা ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে। সেটিই দিল।’ আর টানা চতুর্থ ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার নেওয়ার পর মেসি জানালেন, ওই সময়টাতে তাঁর মাথায় কত রকম চিন্তা খেলা করছিল! ‘একটা মাত্র ভুলেই আমরা বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়তে পারি। পেনাল্টি শ্যুটআউটে গেলে যেকোনো কিছুই হতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হলো, একটা চান্স নিই। তখনই ডি মারিয়াকে দেখলাম।’ বলার পর হাসি দিয়ে স্বীকার করলেন, ‘আমরা ভাগ্যবান। আজ ভাগ্য আমাদের পক্ষে ছিল।’
তা তো ছিলই। নইলে ডি মারিয়ার ওই গোলের পরও তো ম্যাচটা টাইব্রেকারে প্রায় চলেই গিয়েছিল। ‘আল্পসের মেসি’ শাকিরির দুর্দান্ত ক্রসে জেমাইলির হেডটা পোস্টে লেগে ফিরল। ফিরতি বলটাও লেগেছিল পায়ে। সেটি গোলেও যেতে পারত। কিন্তু চলে গেল বাইরে।
এই ম্যাচের আগে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ঐতিহাসিক বৈরিতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন সুইস গোলরক্ষক বেনাগলিও। আর্জেন্টিনা তিনটি গ্রুপ ম্যাচই খেলেছে যেন নিজেদের দেশের মাঠে। গ্যালারিভরা শুধু আর্জেন্টাইন আর আর্জেন্টাইন। এই ম্যাচে অন্যরকম আশা করেছিলেন বেনাগলিও। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের কাছ থেকে এমন উৎসাহ পেয়েছেন যে তাঁর মনে হয়েছিল গ্যালারিতে সুইসদের সঙ্গে মিলে ব্রাজিলিয়ানরা অ্যারেনা করিন্থিয়ানসকে সুইজারল্যান্ডের ‘নিজের মাঠ’ বানিয়ে ফেলবে।
ঠিক সেটা হয়নি। তবে গ্যালারিতে আর্জেন্টিনার একাধিপত্য আর থাকেনি। সেখানে পক্ষ-বিপক্ষ প্রায় সমানে সমান। প্রতিপক্ষ অংশটা অবশ্য সুইজারল্যান্ডকে সমর্থনের চেয়ে আর্জেন্টিনাকে দুয়ো দেওয়াতেই বেশি ব্যস্ত থাকল।
প্রথমার্ধে সেই সুযোগও অনেক এল। আর্জেন্টিনা একেবারেই এলোমেলো। সুইজারল্যান্ড সহজ দুটি সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফেলতে পারলে মেসি-জাদুতেও কাজ হতো না। তবে দ্বিতীয়ার্ধে মনে হলো, হ্যাঁ, একটি দলের নাম আর্জেন্টিনা। কিন্তু আক্রমণের পর আক্রমণের ঢেউ বইয়ে দিয়েও গোলের দেখা আর মিলছিল না।
শেষ পর্যন্ত দেখা মিলল, যখন সবাই আরেকটি টাইব্রেকারের হাসি-কান্নার অপেক্ষায়।
বিশ্বকাপ একটা হচ্ছে বটে!