পাঁচ বছর আগে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেই দৃশ্যটা নিশ্চয়ই মনে আছে বার্সেলোনার সমর্থকদের।
রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ২-২ গোলে সমতায় ছিল বার্সা। জর্দি আলবার পাস থেকে ম্যাচের শেষ কিকে গোল করে স্কোরবোর্ড পাল্টে দেন লিওনেল মেসি। ৩-২ গোলের রোমাঞ্চকর জয় তুলে নেয় বার্সা। গায়ের জার্সিটা খুলে রিয়াল সমর্থকদের দিকে উঁচিয়ে ধরেছিলেন মেসি। যেন বোঝাতে চাচ্ছিলেন, দেখে নাও, গোলটা কার!
তখন মেসির জার্সিটা কি রিয়ালের দু-একজন সমর্থকের পেতে ইচ্ছা করেনি? বার্সার হয়ে সেটি ছিল তাঁর ৫০০তম গোল। সরাসরি না বললে সম্ভবত ভুল হবে। খেলোয়াড়টির নাম যেহেতু মেসি, শুধু রিয়াল কেন, পৃথিবীর যেকোনো দলের সমর্থকই তো তাঁর ৫০০তম গোলের স্মারক জার্সিটি পেতে চাইবেন।
কানাডার নাগরিক অনিশ কানাবার তেমনই এক ফুটবলভক্ত। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বার্নাব্যুতে মেসির উঁচিয়ে ধরা সে জার্সিটা এখন তাঁর সংরক্ষণে। এখন তো তারকাদের জার্সি সংরক্ষণে থাকলে তা নিলামে তুলে অনেকেই দু-পয়সা আয় করছেন।
কিন্তু অনিশ কানাবার অন্য ধাতে গড়া মানুষ। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম ‘লা নাসিওন’কে নিজের ইচ্ছাটা বললেন অনিশ, ‘খুব টাকার দরকার না পড়লে এই জার্সি আমি বেচব না। সারা জীবন নিজের কাছে রাখতে চাই।’
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বসবাস করা ২৪ বছর বয়সী অনিশের কাছে জার্সিটা আসার আগে আরও দুবার হাতবদল হয়। সেদিন ম্যাচ শেষে রিয়ালের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে জার্সি বদল করেন মেসি। রিয়ালের সেই খেলোয়াড়ের নাম জানা না গেলেও এতটুকু জানা গেছে, তিনি জার্সিটি পাঁচ বছর নিজের কাছে রেখেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে জার্সিটি কিনে নেন আর্জেন্টিনার ব্যবসায়ী এবং মেসির খেলার বিভিন্ন সময়ে জার্সি ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংরক্ষণ করে খ্যাতি কুড়ানো দামিয়ান অলিভেরা। জার্সিটি তিনি গোল্ডিনের সাইটে নিলামে তোলেন। তখন সুযোগটা পেয়ে যান অনিশ কানাবার।
সাড়ে চার লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি ২১ লাখ টাকা) খরচ করে জার্সিটি কিনে নেন তিনি। তখন পর্যন্ত সেটাই ছিল কোনো ফুটবল জার্সির জন্য সর্বোচ্চ দাম দেওয়ার নজির। ডিয়েগো ম্যারাডোনা পরে এই রেকর্ড ভেঙে দেন প্রমাণ ব্যবধানে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি যে জার্সি পরে খেলেছিলেন, সেটি নিলামে প্রায় ৯০ লাখ ডলারে বিক্রি হয়।
অনিশের কাছে মেসির সেই জার্সির আবেদন কেমন হতে পারে? কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ুয়া এই ছাত্র ইনস্টাগ্রামে তা নিজেই জানিয়েছেন, ‘নিজের ৫০০তম গোলে এল ক্লাসিকোর ভাগ্য নির্ধারণের পর এই জার্সিটা মেসি উঁচিয়ে ধরেছিলেন। এটা হলি গ্রেইলের (যীশুর পানপাত্র) মতোই পবিত্র।’ তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু অনিশের মতো ছাত্র ব্যক্তিগত সংগ্রহ সমৃদ্ধ করতে কীভাবে এত টাকা পেলেন?
অনিশ জানান, ১০ বছর আগে হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন জিনিস বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। এভাবে একদিন বুঝতে পারেন, খেলাধুলার বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহে রাখাটা লাভজনক। তারকাদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র হলে তো কথাই নেই। মেসির বাইরে আরও একজন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির জার্সি সংগ্রহে রেখেছেন অনিশ, ‘আমি ফুটবল পছন্দ করি। এক সময় খানিকটা খেলেছি। নিজের পছন্দের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহে রাখা শুরু করি তখন থেকে। মেসি ও ডিয়েগো ম্যারাডোনার জার্সি সংগ্রহ করেছি, কারণ, তাঁরা আমার প্রেরণা। তাঁদের মতো আর কাউকে দেখিনি।’
আর্জেন্টিনা দল মাঠে নামলেই তাদের খেলা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন না অনিশ। মাঝেমধ্যে আর্জেন্টিনা দলের খেলার সিডি দেখেন। মেসিকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা, ‘জাতীয় দলের হয়ে তাঁর কোনো কিছু জিততে দেখাটা দারুণ ব্যাপার। এখন তাঁকে বিশ্বকাপ জিততে দেখতে চাই। আমার মনে হয় বিশ্বের অনেকেই তা চায়।’
পেপ গার্দিওলা বার্সার কোচ থাকতে ২০০৯ সালে ‘ট্রেবল’ জিতে সোনায় মোড়ানো বছর কাটিয়েছে বার্সা। সে বছর ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে লা লিগায় মেসি যে জার্সি পরে খেলেছিলেন, তা এখন অনিশের সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করছে। আরও আছে।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্লে-অফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যারাডোনার পরা জার্সিটিও আছে তাঁর সংগ্রহে। আর্জেন্টিনার দুই প্রজন্মের এই দুই কিংবদন্তির মধ্যে কে সেরা—এই প্রশ্নে ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে হলো অনিশকে, ‘এটা ঠিক করে বলা কঠিন। লিও দীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষে। আমার জীবনে কখনো তাঁর মতো কাউকে দেখিনি। কিন্তু ডিয়েগো বিশ্বকাপ জিতেছে। তাই আমার মনে হয়, মেসি বিশ্বকাপ জিতলেই তাঁকে সর্বকালের সেরা বলতে আর কোনো যুক্তি-তর্কের অবকাশ থাকবে না।’
সব যুক্তি-তর্ক শেষে অনিশ যে শেষ পর্যন্ত মেসিরই ভক্ত—সে কথাও স্পষ্ট করে বললেন, ‘সত্যিটা হলো মেসি যে দলে খেলে, আমি সে দলেরই ভক্ত। তাঁর জন্য বার্সার সমর্থক ছিলাম। এখন পিএসজির জন্য গলা ফাটাই। অর্থাৎ মেসি যে দলেই খেলুন না কেন, আমি সে দলেরই ভক্ত।’
মেসির এমন ভক্তসংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়! কিন্তু সবার কি আর অনিশের মতো মেসির জার্সি সংগ্রহে রাখার ভাগ্য আছে!