মেসির হাতেই উঠুক কাপ

ঢাকার একটি গলির দেয়ালে আর্জেন্টিনা ও জার্মান দলের খেলোয়াড়দের প্রতিকৃতি
ঢাকার একটি গলির দেয়ালে আর্জেন্টিনা ও জার্মান দলের খেলোয়াড়দের প্রতিকৃতি

আপনারা আজ বিশ্বকাপের ফাইনালের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। রাত জাগতে হবে, সেটা কোনো ব্যাপারই নয়। যাঁরা রোজা রাখেন রোজার মাসে সেহ্রির জন্য তো তাঁদের উঠতেই হতো। আর্জেন্টিনার জার্সি পরে বাবা-ছেলে-মেয়ে ঘরে ঘরে বসে যাবে খেলা দেখতে। কেউ-বা যাবে বন্ধুর বাড়িতে, বড় পর্দায় খেলা দেখা আর কলা বেচা, মানে বন্ধুকৃত্য সারা, দুটোই হবে। হল বা ছাত্রাবাসগুলোতে একেবারে এলাহি কাণ্ড ঘটে যায়। বড় বড় পতাকা নিশ্চয়ই ঝুলছে আর্জেন্টিনার। বাংলাদেশে আগে থেকেই কিছু জার্মানির সমর্থক ছিল, এখন হয়তো আরও কিছু বেড়েছে। ব্রাজিলের সমর্থকেরাও কায়মনোবাক্যে, বেশির ভাগই, জার্মানির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, সন্দেহ কী।
আর আমি ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ার গ্যারিঞ্চা স্টেডিয়ামের আধা মাইলের মধ্যে হোটেলে বসে আছি। এখান থেকে স্টেডিয়াম দেখা যায়। ৫ জুলাই এখানেই আর্জেন্টিনাকে জিততে দেখেছি বেলজিয়ামের সঙ্গে। এখন অপেক্ষা ব্রাজিল হল্যান্ড ম্যাচের জন্য। আপনারা যখন এই লেখা পড়বেন, তখন ম্যাচ হয়ে গেছে। ফল আপনাদের জানা।
বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলাটা কেমন?
নিজের প্রেমিকার বিয়েতে আপনি যদি উপস্থিত থাকেন, আর হ্যাঁ, বিয়েটা আপনার সঙ্গে হচ্ছে না, আর কারও সঙ্গে হচ্ছে, তাহলে যে অনুভূতি হতে পারে, তৃতীয় স্থানের জন্য ব্রাজিলের খেলার উৎসবটা ঠিক তেমনি। এ যেন প্রভাতের মলিন বাঁকা শশী, সুখের চেয়ে হেথা দুঃখ যে মাখা বেশি।
আজকের দিনে আপনাদের নতুন খবর কি শোনাতে পারব?
আর্জেন্টিনা জিতবে, নাকি জার্মানি?
প্রত্যাশা করি, আর্জেন্টিনা জয়লাভ করুক। কাপ আমেরিকায় ফিরে আসুক। আনন্দের জন্য খেলা, দরিদ্র পরিবারগুলো থেকে সহজাত প্রতিভা নিয়ে বেড়ে ওঠা স্বভাব-খেলোয়াড়দের জয় হোক। মেসি তো বর্তমান দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়, নেইমার ঠিকই বলেছেন, বিশ্বকাপ তাঁর হাতেই মানায়। এবিসি নিউজ বলছে, মেসি চারবার এই গ্রহের এক নম্বর খেলোয়াড়ের ফিফা স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব পাঁচটি জায়গায়, এক, গতি, বল নিয়ে ১০০ মিটারের দৌড়ে কেউ তাঁর সঙ্গে পারে না। দুই, ভারসাম্য, ম্যারাডোনার মতোই তিনি অনুচ্চ, ফলে তাঁর ভরকেন্দ্র ঠিক থাকে, তিনি ভারসাম্য হারান না। তিন, তিনি নির্ভুল, ফ্রি-কিকই বলুন, পাস দেওয়াই বলুন, গোলে শট নেওয়াই বলুন, সাধারণত তিনি লক্ষ্যভেদী, নির্ভুল। চার, ধৈর্য, প্রতিপক্ষ তাঁকে পাহারা দিয়ে রাখে, তাঁকে নিষ্ক্রিয় করতে চায়, তিনি ধৈর্যহারা হন না। ঠিক সময় ও জায়গা খুঁজে বের করেন। পাঁচ, বুদ্ধি, তাঁর আছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, ফুটবলের জরুরিতম বোধটি। তিনি জানেন কখন কোন দলের সঙ্গে কী করতে হবে। আর ইংল্যান্ডের সাবেক তারকা ফুটবলার গ্যারি লিনেকার বিবিসিতে বলছেন, এ পর্যন্ত বিশ্বকাপের খেলায় মেসি তাঁর সেরাটি খেলতে পারেননি। মেসি যা খেলেছেন, তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো খেলোয়াড়। গ্যারি লিনেকার হতাশই হয়েছেন।
তাহলে কি আজ মেসি সেটা পুষিয়ে দেবেন? আজ কাপ উঠবে তাঁর হাতে, তাঁর নেতৃত্বে? সোনার হাতে সোনার কাপ, কে কার অলংকার। অবশ্য সোনার বল, সোনার বুট প্রসঙ্গও আসবে, সে ক্ষেত্রে বলতে হবে, সোনার পায়ে সোনার বুট, কে কার অলংকার। তখন আবার জার্মানির কথাও আসবে। আমরা, বেশির ভাগ বাংলাদেশি, জার্মানিকে সমর্থন করি না বলে জার্মানির কৃতিত্বগুলো আমাদের চোখে পড়ছে না। ক্লোসার গৌরব, মুলারের অর্জন আমরা দিব্যি চেপে যাই। দল হিসেবে বিশ্বকাপে জার্মানির কীর্তি মোটেও কম না। আর ব্রাজিলের সঙ্গে জার্মানির খেলাটা যদি জার্মানির চোখ দিয়ে দেখি, তাহলে বলতেই হবে, তারাও অনবদ্য ফুটবলই খেলে। বলা হচ্ছে, এটা জার্মানির গোল্ডেন জেনারেশন, সোনালি প্রজন্ম। অবশ্য একই কথা বলা হচ্ছে আর্জেন্টিনা সম্পর্কেও। বেলজিয়াম ও হল্যান্ডকে হারিয়ে যারা ফাইনালে উঠতে পারে, সোনার কাপের তারা দাবিদার। আবার ফ্রান্স আর ব্রাজিলকে হারিয়ে যারা এত দূর এসেছে, এই টুর্নামেন্টে সর্বাধিক গোল করেছে, তারাই বা কাপের দাবি ছাড়বে কেন?
তাহলে উৎপল শুভ্রর শেখানো রসিকতাটা করি, আজকের খেলায় যে বেশি গোল দেবে, সেটা পেনাল্টিতেই হোক, আর অন্যভাবে হোক, তারাই হবে চ্যাম্পিয়ন।
আমার নিজের বিশ্লেষণ ছিল, ফাইনালে একটা আমেরিকার দল, একটা ইউরোপের দল খেলবে। কাজেই হয় ব্রাজিল না হলে আর্জেন্টিনা। অন্য দিকে আমার হিসাব ছিল হয় জার্মানি নয়তো স্পেন। কিন্তু আমার মন বলছে, কাপ এবার আমেরিকার প্রাপ্য। জয় আর্জেন্টিনার হবেই কিন্তু আমার বাসায় একজন ফুটবল-বিশ্বকোষ আছেন, আমার মেয়ে। চার বছর আগে তিনি পিতৃদ্রোহী হয়ে বললেন, বাবা, আমি কিন্তু স্পেনের সমর্থক, কারণ ওঁরা সবাই রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার খেলোয়াড়। ওঁরাই এবার চ্যাম্পিয়ন হবে। প্রথম দিনে সুইজারল্যান্ডের কাছে স্পেন হেরে গেলে তাঁর সে কী কান্না। কিন্তু শেষ হাসিটা সেই হেসেছিল। এবার খেলার প্রথম দিনেই তাঁর ঘোষণা, আমি স্পেনের সাপোর্টার বটে, কিন্তু বাবা চ্যাম্পিয়ন হবে জার্মানি। খুবই ভালো দল।
আমি বললাম, তোমার জন্য কী আনব ব্রাজিল থেকে। বলল, পারলে ম্যাটসকে নিয়ে এসো।
এখন আর্জেন্টিনা জিতলে রোস্তম জেতে, জার্মানি জিতলে সোহরাব।
ব্রাজিলিয়ানরা আবার ভিড় করেছে হলুদ-সবুজ জার্সি পরে। এখানে ব্রাসিলিয়ায়। কমলা রঙের জার্সিও দেখতে পাচ্ছি। খেলা দেখার পরে না হয় আপনাদের এই স্টেডিয়ামের বর্ণনা খানিকটা দেব। এখন বলি, আমার মন পড়ে আছে বাংলাদেশে। যেখানে আমির-ফকির সব ব্যবধান দূর হয়ে গেছে। যারা আর্জেন্টিনার সমর্থক, তারা শ্রেণীভেদ-লিঙ্গভেদ ভুলে আত্মীয়তা অনুভব করছেন। যাঁরা আর্জেন্টিনার সমর্থক নন, তাঁরা জার্মানির তরণীতে উঠে বিশ্বকাপসিন্ধু পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। কী পাগলামোতে পরিপূর্ণ একটা মাস গেল বাংলাদেশে। হাসি-কান্না। ঝগড়া-বিবাদ। ভাইয়ে ভাইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। স্বামী-স্ত্রী মনোমালিন্য। আর্জেন্টিনা জিতল, মনে হলো, আমিই তো জেতালাম। ফেসবুকে কী সুন্দর লিখছে, আমরা যখন গোল দিই, ওরা তখন এই করছে। গোল কে করছে, না, আমাদের ফিরোজ, আনোয়ার, শিবু। কে খাচ্ছে, না, আমাদের পিয়াস, সরয়ার, মিল্টন। বিউটি, সাবিনা, তৃণারা বলছে, আর্জেন্টিনাই তো জিতবে, ওই ওটা কে মেসি না? আরে ওটা মেসি না, ওটা ডি মারিয়া, তুমি চুপ করো তো।
এই ঝড় থেমে যাবে। শান্ত হয়ে পড়বে সমুদ্র উপকূল লোকালয়। আবার চারটা বছর পরে এই মহাসাইক্লোন আসবে। যার উৎপত্তিস্থল হবে রাশিয়া। কিন্তু বড় ঢেউটা আছড়ে পড়বে বাংলাদেশে। যে দেশের ফিফা র্যাঙ্কিং উল্টো দিক থেকে গুনলে সুবিধা! যে দেশের মানুষ পেট পুরে সবাই খেতে পায় না। কী আশ্চর্য না!
পেট ভরে তার ভাত ছিল না, পেট ভরে সে স্বপ্ন দেখত। পেট ভরে তারা ফুটবল দেখত! জানেন, ব্রাজিলে যে দেশের লোকের সঙ্গেই দেখা হোক, যখন জিজ্ঞেস করে কোন দেশ, বলি ‘বাংলাদেশ’, তখন তারা এক নামেই চেনে দেশটাকে। বাংলাদেশ।