ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো দস সান্তোস।
চেনা গেল? সম্ভাবনা খুবই কম।
গারিঞ্চা?
এবার বুঝে ফেলার কথা, ওটা গারিঞ্চার পুরো নাম।
ফুটবল ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে গারিঞ্চা নামেই। গারিঞ্চা মানে ছোট পাখি। যে নামটা দিয়েছিলেন বড় বোন রোসা। সেই গারিঞ্চা বিশ্বকাপে ব্রাসিলিয়ায় স্বাগত জানাচ্ছেন সবাইকে।
অবশ্যই সশরীরে নয়। এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে গেছেন ৩১ বছরেরও বেশি। তবে গারিঞ্চা এখনো বেঁচে আছেন ফুটবল ইতিহাসে, ফুটবল-রূপকথায়, ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে। ‘হৃদয়’ কথাটা গারিঞ্চাকে বুঝতে খুব জরুরি। ফুটবলটা হৃদয় দিয়েই খেলতেন, মস্তিষ্ক দিয়ে নয়। ব্রাজিলিয়ানরাও আর কোনো ফুটবলারকে এমন হৃদয়ে তুলে নেয়নি। এমনকি ‘ও রেই’ মানে ‘দ্য কিং’ পেলেকেও এখানে হারতে হচ্ছে। আগেও যা জানা ছিল, সপ্তাহ দুয়েকেরও বেশি ব্রাজিলে কাটিয়ে সেটি আরও ভালো করে বুঝলাম। ব্রাজিলিয়ানরা পেলেকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে গারিঞ্চাকে।
ব্রাসিলিয়ার স্টেডিয়ামটি এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বিশ্বে যত ফুটবল স্টেডিয়াম আছে, শুধু একটি বানাতেই এর চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে—লন্ডনের ওয়েম্বলি। স্টেডিয়ামের মূল প্রবেশপথের সামনেই একটা ফলক—এস্তাদিও ন্যাশিওনাল মানে গারিঞ্চা। ‘এস্তাদিও ন্যাশিওনাল’ মানে ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। ‘মানে’ ম্যানুয়েলের সংক্ষিপ্ত রূপ। স্টেডিয়াম এখানে আগে থেকেই ছিল। বিশ্বকাপের জন্য নতুন করে বানাতে যেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে ২০১০ সালে।
ব্রাসিলিয়ার অন্য সবকিছুর মতো নতুন এই স্টেডিয়ামও খুব সাজানো-গোছানো। আধুনিক স্থাপত্যের আরেকটি নিদর্শন। গারিঞ্চার সঙ্গে যা একদমই যায় না! গারিঞ্চা মানে তো এলোমেলো হাওয়া, নিয়ম ভাঙার গান। সেটি কি ফুটবল মাঠে, কি জীবনে!
রিও ডি জেনিরোর উপকণ্ঠে পাউ গ্রান্ডেতে কাটানো শৈশবে ফুটবলটা যেমন মনের আনন্দে খেলতেন, আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও খেলে গেছেন সেভাবেই। এমনকি বিশ্বকাপেও। কেমন অবিশ্বাস্য শোনায়, ১৯৫৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রতিপক্ষের নামই নাকি জানতেন না গারিঞ্চা! প্রতিপক্ষ কে, তাতে যে কিছু আসত যেত না। গারিঞ্চা খেলতেন নিজের খেলা। তাঁর কাছে ফুটবলের অর্থ ছিল একটাই—বল নিয়ে খেলা।
জন্মেছিলেন অদ্ভুত দুটি পা নিয়ে। ডান পা ভেতরের দিকে বাঁকানো, বাঁ পা বাইরের দিকে। দুটি আবার ছোট-বড়ও। কোনো দিন হাঁটতে পারবেন কি না, সংশয় ছিল এ নিয়েই। সেই বাঁকানো দুই পায়ের ড্রিবলিংয়েই প্রতিপক্ষের জীবন ওষ্ঠাগত করে তুলতেন। গারিঞ্চার কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের বোকা বানানো। ফুটবল তাঁর চেয়ে বড় ড্রিবলার সম্ভবত দেখেনি। সেই ড্রিবলিং এমনই নেশা ছিল যে, এমনও হয়েছে কাউকে কাটিয়ে বল নিয়ে ঘুরে গেছেন আবার তাঁকে কাটাতে। বল এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের নিয়ে মাঠে এমন কাণ্ড করতেন, দর্শকেরা হেসে গড়াগড়ি খেত।
স্তব্ধও হয়ে যেত কখনো কখনো। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের আগে ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্টিনার বিপক্ষে ব্রাজিলের শেষ প্রস্তুতি ম্যাচ। তিনজন ডিফেন্ডারের পর গোলরক্ষককেও কাটানোর পর সামনে খালি গোল। অথচ গারিঞ্চা বল পায়ে অপেক্ষায়। একজন ডিফেন্ডার ছুটে এলেন। গারিঞ্চার ফেইন্টে ভারসাম্য হারিয়ে তাঁকে টাল সামলাতে হলো পোস্ট ধরে। গারিঞ্চা বল পায়ে হেঁটে হেঁটে গোলে ঢোকার পর ফ্লিক করে বলটি তুলে বগলে নিয়ে মাঝবৃত্তের দিকে হাঁটা ধরলেন। দর্শকদের স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল দুশ্চিন্তা, এই লোক বিশ্বকাপে গিয়ে কী না কী করে বসে!
যে ‘ওলে, ওলে’ ধ্বনি এখন লাতিন আমেরিকান ট্রেডমার্ক, সেটিরও জন্মদাতা নাকি গারিঞ্চাই। ১৯৫৮ সালে বোটাফোগো-রিভার প্লেট প্রদর্শনী ম্যাচ। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার ভাইরো বারবার দৌড়ে এসে গারিঞ্চাকে চার্জ করছেন, আর গারিঞ্চা তাঁকে নিয়ে ছেলেখেলা খেলছেন। এই দৃশ্য দেখেই নাকি দর্শকদের মধ্য থেকে প্রথম ‘ওলে, ওলে’ চিৎকারের শুরু। ওই ম্যাচেই একবার বল ছাড়াই এঁকেবেঁকে দৌড় শুরু করেন, বুঝতে না পেরে ভাইরোও পেছনে দৌড়াচ্ছেন। দর্শকেরা সব হেসে লুটোপুটি।
মাঠে বিনোদনের লীলাভূমি বানিয়ে ফেলা এসব ছেলেমানুষি কাণ্ডের কারণেই গারিঞ্চার নাম হয়ে গিয়েছিল—আলেগ্রিয়া দো পোভো। যার অর্থ—জয় অব পিপল। এর চেয়েও বিখ্যাত নাম ‘আনজো দ্য পারনাস টরলাস’। অ্যাঞ্জেল উইথ বেন্ট লেগস। বাঁকা পায়ের দেবদূত। যে নামটি দিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান কবি ভিনিসিয়াস ডি মোরায়েস।
ট্যাকটিকস-স্ট্র্যাটেজি এসব ছিল তাঁর কাছে অর্থহীন। ১৯৬২ বিশ্বকাপেরই গল্প বোধ হয় এটা। কোচ বোর্ডে এঁকে বোঝাচ্ছেন, প্রতিপক্ষ এই করবে, আমরা তখন এই করব। গারিঞ্চা হাই তুলে বললেন, ‘প্রতিপক্ষ এই করবে, ওই করবে বলছেন, আপনি কি ওদের বলেছেন এমন করতে?’ বোটাফোগোর কোচ বেশি ড্রিবলিং ঠেকাতে অনুশীলনের সময় মাঠের একটা জায়গায় চেয়ার রেখে ক্রস করার জন্য সীমানা বেঁধে দিলেন। গারিঞ্চা সেই চেয়ারকেও কাটাতে শুরু করলেন!
ফুটবলটা এত সিরিয়াসলি নেওয়ার কী আছে, কখনোই তা বুঝতে পারেননি। ১৯৫০ বিশ্বকাপে ‘মারাকানাজো’ তাঁকে স্পর্শই করেনি। খেলাও দেখেননি, কিশোর গারিঞ্চার কাছে
মাছ ধরাটা এর চেয়ে জরুরি মনে হয়েছিল।
পরের বিশ্বকাপেই ওই ‘মারাকানাজো’র দুঃখে প্রলেপ পড়ল পেলে-গারিঞ্চাদের সৌজন্যে। পেলে আর গারিঞ্চার একই সঙ্গে বিশ্বকাপে অভিষেক। এই দুজনই খেলেছেন, এমন কোনো ম্যাচে কখনো হারেনি ব্রাজিল। ১৯৬২ বিশ্বকাপ জেতাতে পেলেকেও লাগেনি গারিঞ্চার। কোনো খেলোয়াড়ের একক কৃতিত্বে বিশ্বকাপ জয়ের কথা বললে ১৯৮৬-এর ম্যারাডোনার পাশেই থাকেন ১৯৬২-এর গারিঞ্চা।
কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত ওই ড্রিবলিং-প্রতিভা ছাড়া গারিঞ্চার যে আর কিছুই যে ছিল না! ১৯৫৮ বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের পরীক্ষা নিয়েছিলেন মনস্তত্ত্ববিদ। ফলাফল দেখে স্তম্ভিত। গারিঞ্চার ‘আক্রমণাত্মক মানসিকতা’ বলতে কিছু নেই, বুদ্ধিমত্তার স্তর বাস ড্রাইভার হওয়ারও উপযুক্ত নয়।
মাঠের বাইরের জীবনটা এলোমেলো হয়তো এ কারণেই। বিশ্ব জয় করে ফেলার পরও বোটাফোগোতে নামমাত্র টাকায় খেলে গেছেন। কখনো সাইন করে দিয়েছেন সাদা চুক্তিপত্রেও। বৈষয়িক কোনো চিন্তাই ছিল না। চাহিদা বলতে মদ আর নারীসঙ্গ। দুই বিয়েতে বৈধ সন্তানের সংখ্যা ১৩। এর বাইরেও আরও সন্তানাদি আছে বলে ধারণা।
গারিঞ্চাকে নিয়ে যেসব গল্প শোনা যায়, বাস্তববুদ্ধি বলতে কিছু ছিল বলে মনে হয় না। গারিঞ্চাকে সাহায্য করতেই ব্রাজিল কফি ইনস্টিটিউটের দূত করা হয়েছিল তাঁকে। কাজ বলতে স্যুট-ট্যুট পরে লোকের সঙ্গে হাত মেলানো। সেটিতেও দর্শনীয় রকম ব্যর্থ হতে সক্ষম হন।
বোলোনিয়াতে ব্রাজিলিয়ান কফি প্রদর্শনীকে এক ইতালিয়ান গারিঞ্চাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ব্রাজিলিয়ান কফি কি সত্যিই ভালো?’
গারিঞ্চা উত্তর দিলেন, ‘জানি না। আমি এটা কোনো দিন খাইনি। তবে আমি তোমাকে বলতে পারি, ব্রাজিলিয়ান কাশাচা দুর্দান্ত জিনিস।’
‘কাশাচা’ ব্রাজিলের একধরনের অ্যালকোহলিক পানীয়। ৪৯ বছর বয়সেই লিভার সিরোসিসে গারিঞ্চার জীবন শেষ করে দেওয়ার মূলেও ওই ‘কাশাচা’। মারাকানায় কফিন নেওয়া হলো। সেখান থেকে পাউ গ্রান্ডে পর্যন্ত গারিঞ্চার কফিনবাহী গাড়ির সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ।
‘জয় অব পিপল’-এর শেষ শোভাযাত্রা তো এমনই হওয়ার কথা!