সমুদ্রে অসুস্থ হয়ে পড়লে নুরুল হাসানকে শুশ্রুষা দিচ্ছেন সতীর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ।
সমুদ্রে অসুস্থ হয়ে পড়লে নুরুল হাসানকে শুশ্রুষা দিচ্ছেন সতীর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ।

ভয়ংকর সমুদ্রযাত্রা, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ক্রিকেটাররা

সেন্ট লুসিয়া টু ডমিনিকা, ভায়া মার্টিনেক। ভয়ংকর এক সমুদ্রযাত্রা শেষে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে ডমিনিকায় এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশ দল। ২ জুলাই ডমিনিকার উইন্ডসর পার্কে টি–টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর আগে মাত্র একদিন বিরতি। তার মধ্যে ক্রিকেটাররা সমুদ্রযাত্রার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারে কি না, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।

সেন্ট লুসিয়ার ক্যাস্ট্রিস ফেরি টার্মিনাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় মার্টিনেকের উদ্দেশে রওনা দেয় পার্লে এক্সপ্রেসের ফেরি। সেন্ট লুসিয়া থেকে মার্টিনেক হয়ে ডমিনিকা, এরপর আরো কয়েকটি দ্বীপ—এই পথে নিয়মিতিই যাতায়াত করে এই ফেরি।

তবে সমুদ্রযাত্রা নিয়ে ভয় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আগে থেকেই ছিল। কারোরই যে অভিজ্ঞতা ছিল না দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা সমুদ্র পাড়ি দেয়ার! তার ওপর দুই দিন আগের সাইক্লোনের কারণে সমুদ্রে ঢেউয়ের তোড়ও বেশি ছিল। সব মিলিয়ে বিভীষিকাময় এক অভিজ্ঞতাই হয়েছে ক্রিকেটারদের।

সমুদ্র যাত্রার আগে সেন্ট লুসিয়ার ক্যস্ট্রিস ফেরি টার্মিনালে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ।

সেন্ট লুসিয়া থেকে বের হয়ে ফেরি যখন মাঝ সমুদ্রে নামল তখনই শুরু হয় ঢেউ। ফেরি বেশি বড় ছিল না, ৬–৭ ফুট উচ্চতার ঢেউয়েই উথাল–পাথাল অবস্থা। বিশেষ করে ডলফিন চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার সময় ঢেউটা বেশি অনুভূত হয়েছে।

নিয়মিত সমুদ্রযাত্রীদের কাছে এটা হয়তো স্বাভাবিকই, কিন্তু যারা নতুন, তাদের জন্য এই অভিজ্ঞতা মোটেও সুবিধার নয়। একে মাঝসমুদ্রে উথাল–পাথাল ঢেউয়ে পড়ার ভয়, সঙ্গে ‘মোশন সিকনেসে’ও আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে এমন যাত্রায়। বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের জন্য খেটে গেছে দুটোই।

শুরুতে ফেরি যখন স্টার্ট দিল, সবাই খুব হৈ–চৈ করে যাত্রা শুরু করল। পেছনের ডেকে জড়ো হয়ে চলছিল সেলফি তোলা আর নীল সমুদ্রের ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক এবং সাধারণ কিছু যাত্রী— সব মিলিয়ে শুরুতে মনে হচ্ছিল বুঝি নৌ–বিহারেই যাচ্ছে কেউ।

এই ফেরিতে চড়েই সেন্ট লুসিয়া থেকে ডমিনিকা গেছে বাংলাদেশ দল।

কিন্তু ঢেউয়ের ধাক্কায় ফেরির বড় বড় দুলুনিতে এরপরই একে একে ‘মোশন সিকনেসে’ আক্রান্ত হতে শুরু করেন ক্রিকেটারেরা। সেন্ট লুসিয়া থেকে মার্টিনেক— এই দেড় ঘন্টার যাত্রাতেই সবাই কাবু। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা হয়েছে পেসার শরীফুল ইসলাম, উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান এবং ম্যানেজার নাফিস ইকবালের। তাদের অবস্থা দেখে অন্যরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

মার্টিনেকে ৪০ মিনিটের বিরতিতে নাফিস ও নুরুল কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও শরীফুল মার্টিনেক থেকে ডমিনিকা আসার পথে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। পলিথিনে মুখ ঢুকিয়ে একাধিকবার বমি করতে দেখা গেছে তাকে। অস্থিরতা কমাতে এক পর্যায়ে তো গায়ের টি–শার্টটাই খুলে ফেলেন তিনি।

এর আগে যাত্রার শুরুতেই বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন দলের সঙ্গে থাকা ম্যাসিওর সোহেল। ক্লান্ত হয়ে সেই যে ফেরির ডেকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি, উঠেছেন ফেরি ডমিনিকা পৌঁছানোর পর। এ ছাড়া ‘মোশন সিকনেসে’ ভুগেছেন দলের আরো অনেকেই। সঙ্গে ভয়, আতঙ্ক তো ছিলই।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কারোই এমন সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এলে অন্য বিদেশী দলগুলোও এভাবে সমুদ্রপথে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যায় না। এমনকি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলও এই প্রথম ফেরিতে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে গেল। সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ে অস্বস্তি দেখা গেছে তাদের মধ্যেও। ক্যারিবিয়ান ধারাভাষ্যকার কার্টলি অ্যামব্রোস তো শেষ পর্যন্ত আতহার আলী খান–ইয়ান বিশপদের সঙ্গীই হননি।

শুরুতে সমুদ্রযাত্রাটাকে উপভোগ্যই মনে হচ্ছিল সবার কাছে।

দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সফর পরিকল্পনা স্বাগতিক বোর্ডই করে থাকে। তবে সেটি চূড়ান্ত হয় সফরকারী বোর্ডের সম্মতিতে। ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিসিবির আগেই সুযোগ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের ফেরিযাত্রার প্রস্তাবে রাজী না হয়ে বিমানে ডমিনিকা যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার। সেটি না করে কেন তারা ফেরিতেই ডমিনিকা যাত্রার প্রস্তাবে রাজী হলো, এই প্রশ্ন তুলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ক্রিকেটারদের অনেকেই।

এক ক্রিকেটার এমনও বলেছেন, ‘এখানে অসুস্থ হয়ে মরলে তো আমরা মরব, কারো তো কিছু হবে না।’ দলের একজন সিনিয়র ক্রিকেটার বলছিলেন, ‘এত দেশ সফর করলাম, জীবনে এই অভিজ্ঞতা প্রথম। আমরা কেউই এতে অভ্যস্ত নই। এখন যদি ফেরিতেই কেউ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে কী হবে, খেলা তো পরের কথা। আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সফর।’

ক্লান্ত মাহমুদউল্লাহ। নাফিস ইকবাল চেষ্টা করছেন মুঠোফোনে ঢাকায় যোগাযোগ করতে।

ফেরি মার্টিনেকে পৌঁছানোর আগেই ক্রিকেটাররা ম্যানেজার নাফিস ইকবালকে বলতে থাকেন, তারা সবাই মার্টিনেকে নেমে যাবেন। বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে সেখান থেকে যেন তাদের বিমানে ডমিনিকা যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ কয়েকবারই হোয়াটসঅ্যাপে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সংযোগ পাননি।

পরে নাফিস ইকবাল বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি জানান। কিন্তু বাস্তবতা হলো হঠাৎ করে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। দলের এতজন সদস্যের জন্য একসঙ্গে বিমান টিকেট যেমন পাওয়া সম্ভব নয়, ফ্রেঞ্চ কলোনি মার্টিনেকের ভিসাও তাৎক্ষণিক পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।

ক্রিকেটাররাও যে বিষয়টি বোঝেননি তা নয়। কিন্তু ‘মোশন সিকনেসে’র ঔষধ খাওয়ার পরও একসঙ্গে বেশ কয়েকজনের অসুস্থ হয়ে পড়া এবং নাবিকদের ভাষায় ‘রাফ সি’ ফেরি যাত্রাটাকে করে তুলেছিলে আতঙ্কজনক।

তার মধ্যেও কেউ কেউ যে এই ভ্রমণ উপভোগ করেননি তা নয়। সাকিব আল হাসানকে বলতে পারেন সেই দলের মধ্যমণি। এনামুল হক, ইবাদত হোসেন আর মোসাদ্দেক হোসেনও মোটামুটি উপভোগই করেছেন যাত্রাটা।

ফেরি যাত্রায় দলের সঙ্গে ছিলেন না ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। সমুদ্রভীতির কারণে তিনি আগেই জানিয়ে দেন ফেরিতে ডমিনিকা যাবেন না। অবশ্য টি–টোয়েনটি দলে নেই বলে তামিমের ডমিনিকা আসাটাও জরুরি ছিল না। ওয়ানডে সিরিজের আগে গায়ানায় তাঁর আবার দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা।