আরে, স্কলারি আর নেইমারের সব কথাই তো পরিষ্কার বুঝতে পারছি। তাহলে বাকিদেরটা পারি না কেন?
কানে হেডফোনের সঙ্গে সংযুক্ত হাতে ধরা রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আহা রে, এই ব্যবস্থাটা যদি সব জায়গায় করা যেত! ব্রাজিলে আসার পর থেকে প্রতিদিন সবচেয়ে বড় যে ‘যুদ্ধ’, সেটি আর করতে হতো না।
স্কলারি-নেইমারের কথা এমনিতে বোঝার কোনো কারণই নেই। দুজনই বলছেন ব্রাজিলিয়ান-পর্তুগিজে। ‘ব্রাজিলিয়ান’ শব্দটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বিশুদ্ধ পর্তুগিজ ভাষার সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান পর্তুগিজের একটু পার্থক্য আছে। বিশুদ্ধ স্প্যানিশের সঙ্গে যেমন দক্ষিণ আমেরিকান অন্য সব দেশের স্প্যানিশের। ২০০৬ বিশ্বকাপে স্পেনের এক সাংবাদিক তথ্যটা জানিয়ে বলেছিলেন, মেসিদের স্প্যানিশ বুঝতে তাঁরও একটু সমস্যা হয়।
আমার কাছে কোনো ইতরবিশেষ নেই। সবই সমান দুর্বোধ্য। কারও কারও ভাষা শেখার আলাদা একটা ক্ষমতা থাকে। আমার একদমই নেই। ব্রাজিলে ছয় দিন কাটিয়ে ফেলার পরও যেমন একটা পর্তুগিজ শব্দই শিখতে পেরেছি—অভরিগাদো। অর্থ, ধন্যবাদ। সেটি প্রয়োগ করে খুব ভালো ফলও পাচ্ছি। কেউ কোনো সাহায্য করলেই হেসে বলছি, ‘অভরিগাদো’। বিনিময়ে আরও বড় হাসি উপহার পাচ্ছি।
কিন্তু শুধু ‘অভরিগাদো’ দিয়ে কি আর জীবন চলে! হোটেলের রিসেপশনে ইংরেজি জানা দুটি ছেলেমেয়ে আছে। ওরা না থাকলেই জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কাল রাতে রুম সার্ভিসে কী খেতে চাচ্ছি এটা বোঝানোর প্রাণান্তকর চেষ্টাও যেমন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। ফলাফল—কলা, আপেল আর বিস্কুটে ক্ষুন্নিবৃত্তি।
যা খেতে খেতে স্কলারি ও নেইমারের সংবাদ সম্মেলনের ওই হেডফোনটার কথা মনে পড়ছিল। সব কথা বুঝতে পারছিলাম তো এটির মহিমাতেই। অলিম্পিকের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলেও ভাষার সাঁকো পেরোনোর এই ব্যবস্থাটা আছে। যে ভাষাতেই কথা হোক না কেন, হেডফোনের রিমোট কন্ট্রোল আপনাকে পছন্দমতো অনুবাদ শোনার সুযোগ করে দেবে। ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের সংবাদ সম্মেলন বলে এদিন যেমন তিনটি ভাষার অপশন থাকল। ‘১’ নম্বরে ইংরেজি, ২ নম্বরে ব্রাজিলিয়ান-পর্তুগিজ, ৩ নম্বরে ক্রোয়েশিয়ান।
দেশ অনুযায়ী শেষ দুটি ভাষা বদলাবে, তবে ইংরেজিটা কমনই থাকবে। বিশ্বকাপের সংবাদ সম্মেলন নিয়ে তাই কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের বাইরে যে বিশাল জগৎ, সেখানে যে পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে। যা একদমই ‘খাদ্য’ পদবাচ্য নয়।
লিখতে বসার একটু আগেই যা ‘খেয়ে’ দিনের শুরু। সাও পাওলোতে যে হোটেলে আছি, সেই ব্লু ট্রি টাওয়ার্সের নাশতার আয়োজন ভালোই। সমস্যা একটাই, বুফে আইটেমে ডিম পোচ নেই। একটা বড় পাত্রে ‘স্ক্র্যাম্বলড্ এগ’ মানে ‘চটকানো ডিম’ থাকে, কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের চোখরাঙানিতে ডিমের কুসুম খাওয়া যে অনেক দিনই বাদ। কুসুম ছাড়া ডিম খেতে হলে পোচ বা সেদ্ধ ছাড়া উপায় নেই। প্রথম দিন রেস্টুরেস্টের এক তরুণীকে অনেক যুদ্ধ করে সেটি বোঝাতে পারলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেটে করে ডিম পোচ এল। তাকিয়ে দেখি, সেটিও স্ক্র্যাম্বলড্ এগই, বিশেষ কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বন করায় আরও বেশি হলুদ!
আবারও ‘পার্থপ্রতিম মজুমদার’ হওয়ার চেষ্টা। ভয়ে ভয়ে আছি, এবার না কী নিয়ে আসে! না, ডিম পোচই এল। তিন-চার দিন ভালোই গেল। নাশতা করতে গিয়েই ওই তরুণীকে ইশারা করি। ডিম পোচ চলে আসে। আমি ‘অভরিগাদে’ বলে হাসি উপহার পাই। আজ কোনো কারণে মেয়েটা নেই। দুটি ছেলেকে অনেক চেষ্টা করেও চাহিদাটা বোঝাতে ব্যর্থ। বেচারাদের করুণ অবস্থা দেখে শেষে ক্ষান্ত দিলাম। ডিম পোচ না খেলে কেউ মরে না!
পর্তুগিজটা না জানায় আরও কত রকম সমস্যা যে হচ্ছে। ব্রাজিলে পা রাখার পাঁচ দিনের মাথায় স্কলারি-নেইমারের সংবাদ সম্মেলনের কল্যাণে যাঁদের জন্য এখানে আসা, তাঁদের দেখা পেলাম। অথচ লিখতে তো হয়েছে প্রতিদিনই। ব্রাজিলের পত্রপত্রিকা বিশ্বকাপ ফুটবলে সয়লাব। ছড়িয়ে থাকা লেখার অনেক উপাদান, কিন্তু সেসবের দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। সবই যে পর্তুগিজ! ছবি দেখি, পর্তুগিজ ইংরেজি হরফে লেখা হয় বলে পড়তেও পারি। কিন্তু সেই পড়ায় কী লাভ!
রাস্তাঘাটে ইংরেজি জানা কাউকে পাওয়া হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। মোবাইলে মেসেজ আসে, সব পর্তুগিজে। একটু আগে একটা ফোনও এল। ধরার পরই নারীকণ্ঠে ‘গালাগালি’! মোবাইল কোম্পানির প্রমোশনাল কিছু হবে। বলার ভঙ্গিটা এমন যে, সেটি বুঝে ওঠার আগ পর্যন্ত পর্তুগিজ-ঝড়কে ‘গালাগালি’ই মনে হচ্ছিল।
বুধবার মাঠ থেকে ফেরার সময় খুব মজার একটা অভিজ্ঞতা হলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা ট্যাক্সি পেয়েছি। ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে এখন আর কথা বলার চেষ্টাই করি না। শুধু হোটেলের কার্ডটা হাতে ধরিয়ে দিই। তাতেই কাজ হয়। এদিনও তা-ই করলাম। হঠাৎ লালমুখো মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক মুখ ঢুকিয়ে ট্যাক্সিচালককে কী যেন বলতে শুরু করলেন। গলায় অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখে বুঝলাম, বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা কোনো দেশের সাংবাদিকই হবে। কী একটা ভাষায় ঝড়ের মতো কথা বলে যাচ্ছেন, ‘বারবাকুয়া’ শব্দটা শুধু বারবার ঘুরেফিরে আসছে। অনুমানে বুঝলাম, বারবাকুয়া নামে কোথাও তাঁর হোটেল, সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের সঙ্গী হতে চাইছেন।
ট্যাক্সিচালকের পাশে উঠে বসার পর আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা জরুরি মনে করলেন। নিজের ভাষায় কী যেন বলে যাচ্ছেন, ‘ইংলিশ প্লিজ’ বলার পর হেসে বললেন, ‘ইটালি, নেপলস’। বুঝলাম, এতক্ষণ ইতালিয়ান ভাষা শুনছিলাম। অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড থেকে নামটাও জানলাম, রবার্তো প্রেদো। পত্রিকার নাম মাতিনো, এটির অর্থ যে ‘মর্নিং’ সেটাও জানা গেল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। কিন্তু একটা-দুটি শব্দ বলেই আবার ইতালিয়ান ভাষায় চলে যান। এমনই আলাপী লোক যে, শ্রোতা কিছু বুঝতে পারছে কি না তা নিয়ে একদমই ভাবেন না। আমি দু-একবার ‘ইংলিশ প্লিজ’ বলার পর বিব্রত একটা হাসি দেন, একটু পরই আবার ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। আমি কিছুক্ষণ ‘ইয়া’ ‘ইয়া’ করার পর ক্লান্ত হয়ে চোখ বুঝলাম। কিন্তু রবার্তো প্রেদো মহাশয়কে যে কথা বলতেই হবে!
এবার তাঁর লক্ষ্যবস্তু ট্যাক্সিচালক। তিনি তাঁর মতো ইতালিয়ান বলে যাচ্ছেন, চালক পর্তুগিজ। কে কী বুঝছেন কে জানে, কিন্তু আশ্চর্য এই আলাপচারিতা চলতেই থাকল। কথা বলার ইচ্ছা থাকলে ভাষা যে কোনো সমস্যাই নয়, এই দিব্যজ্ঞানটাও পেয়ে গেলাম।
এই ছাইপাঁশ কি আপনি এখনো পড়ছেন না কি?
অভরিগাদো!
সাও পাওলো
১২ জুন