হার না মানার গল্প

ব্রেকিং ব্যাড ও কিছু উপলব্ধি

>করোনার দিনে এত আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবরে মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর চেয়ে কিছু অনুপ্রেরণার গল্প শুনলে কেমন হয়? আঘাত, চোট, বদভ্যাস থেকে ফিরে আসার গল্প তো অনেকই আছে খেলার জগতে। তার চতুর্থ পর্বে আজ ছেলেদের টেনিসের কিংবদন্তি আন্দ্রে আগাসি ও সাবেক ভারতীয় অলরাউন্ডার যুবরাজ সিংয়ের গল্প –
ব্রুকশিল্ডের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ভেঙে পড়েছিলেন আন্দ্রে আগাসি। ছবি:টুইটার
ব্রুকশিল্ডের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ভেঙে পড়েছিলেন আন্দ্রে আগাসি। ছবি:টুইটার

তাঁর শেষ দেখেছিল সবাই

সংকটের অবস্থা থেকে ফিরে আসার জিন তাঁর পরিবারেই ছিল। মা এলিজাবেথ বেটি আগাসিই যে ব্রেস্ট ক্যানসারকে হার মানিয়ে ফিরেছিলেন! ছেলে তেমন কোনো জটিল রোগে পড়েননি, কিন্তু নেশার অন্ধকার আর মানসিক অবসাদ কাটিয়ে ওঠাও তো আন্দ্রে আগাসির কোনো গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়!

টেনিসে তিনি কেমন ছিলেন, তা তো যুক্তরাষ্ট্রের টেনিস কিংবদন্তির রেকর্ডই বলে। রড লেভারের পর ওপেন যুগে ছেলেদের এককে চার গ্র্যান্ড স্লামের সবগুলো (ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্লাম) জেতা দ্বিতীয় খেলোয়াড় তিনি, যে কীর্তি এরপর ছুঁয়েছেন আরও তিনজন। নামগুলো চেনাই – রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচ। ছেলেদের এককে ক্যারিয়ার গোল্ডেন স্লাম (ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্লাম ও অলিম্পিকে সোনার পদক) জেতা দুজনের প্রথম খেলোয়াড় তিনি। অন্যজন? রাফায়েল নাদাল! আর ক্যারিয়ারের গোল্ডেন স্লামের পাশাপাশি এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর চ্যাম্পিয়নশিপ যোগ করে নিলে, যেটিকে ক্যারিয়ার সুপার স্লামও বলা হয়? সেখানে আন্দ্রে আগাসি অদ্বিতীয়।

এ তো টেনিসে তিনি শেষ পর্যন্ত কী করেছেন, তার বর্ণনা। আর টেনিসে তিনি কেমন হতে যাচ্ছেন, সে ইঙ্গিত সম্ভবত দিয়েছিল আন্দ্রে আগাসির ১৩ বছর বয়সের একটা ঘটনা। ফ্লোরিডাতে টেনিস কোচ নিক বোলেটিয়েরির একাডেমিতে গিয়েছিলেন আগাসি। সেখানে তাঁর তিন মাস থাকার কথা ছিল, বাবা এমানুয়েল মাইক আগাসির পক্ষে এর চেয়ে বেশি খরচ টেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আগাসিকে খেলতে দেখার ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই বোলেটিয়েরি এসে মাইক আগাসিকে বললেন, 'আপনি আপনার চেকটা ফেরত নিয়ে যান, ও এখানে বিনামূল্যেই শিখবে।' ১৯৮৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই পেশাদার টেনিসে অভিষেক আন্দ্রে আগাসির।

সেই সময়ের আগাসি। রেকর্ড তাঁর হয়ে কথা বলে। ছবি: টুইটার

গ্র্যান্ড স্লামে সাফল্য অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই আসেনি। ফ্রেঞ্চ ওপেন, ইউএস ওপেনে সেমিফাইনাল, ফাইনালে যাচ্ছিলেন, কিন্তু গ্র্যান্ড স্লামের শিরোপামঞ্চে ওঠা ১৯৯২ উইম্বলডনেই প্রথম। মজার ব্যাপার, টুর্নামেন্টটাতে সবকিছুতে সাদা পোশাকের দৌরাত্ম্যে বিরক্ত আগাসি উইম্বলডনে খেলেননি ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন তো ক্যারিয়ারের প্রথম আট বছরেই খেলেননি! কে জানে, তা না হলে তাঁর গ্র্যান্ড স্লামের সংখ্যা আরও বাড়ত কি না! ১৯৯২ উইম্বলডনের দুবছর পর আসে ইউএস ওপেন, তার পরের বছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও। ১৯৯৬ অলিম্পিকে সোনাও এসেছে।

এরপরই ছন্দপতন! সে সময়ের স্ত্রী ব্রুক শিল্ডের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না তাঁর, তাতে খেলাটার প্রতিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সঙ্গে যোগ হয়েছিল মাদক সেবন। বিখ্যাত টিভি সিরিজ 'ব্রেকিং ব্যাডে'র কল্যাণে যেটির নাম অনেকেরই জানা – ক্রিস্টাল মেথামফেটামিন। সে সময় আগাসি অবশ্য দাবি করেছিলেন, এক বন্ধু জোর করে দিয়েছিলেন সেটা। পেশাদার টেনিসের সংগঠনের (এটিপি) ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়লেও আগাসি চিঠি লেখে জানান, তাঁর ওই বন্ধু পানীয়ের মধ্যে সেটা মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এটিপি তখন সতর্ক করে ছেড়ে দেয় তাঁকে। কিন্তু পরে আত্মজীবনীতে আগাসি জানান, চিঠিতে মিথ্যা লিখেছিলেন। তিনি আসলেই আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন ক্রিস্টালে।

শিরোপায় চুমু খাচ্ছেন আগাসি। ছবি: টুইটার

যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে তাঁর পারফরম্যান্সে। জয়ের চেয়ে হারের সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছিল। যে আগাসি র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠেছিলেন ১৯৯৫ সালে, ১৯৯৭-তে একটা সময়ে তাঁর র‍্যাঙ্কিং নেমে গিয়েছিল ১৪১-এ! সবাই তখন রায় দিয়ে দিয়েছিল, আগাসি শেষ!

কিন্তু ওই যে, শেষের কাছ থেকে ফিরে আসা তাঁর জিনেই যে আছে! ১৯৯৮ সালে কঠোর কন্ডিশনিং প্রোগ্রাম করে মানসিক ও শারীরিকভাবে ঝরঝরে হয়ে ফেরেন। পাঁচটি শিরোপা জিতে সে বছরই র‍্যাঙ্কিংয়ে ১১০ থেকে উঠে আসেন ৬ নম্বরে। ১৯৯৯ ফ্রেঞ্চ ওপেন জয় দিয়ে পূরণ হয় তাঁর ক্যারিয়ার স্লাম। ঝরঝরে হয়ে ফেরার পরের আগাসি কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন, সেটির প্রমাণ সম্ভবত এই যে, ফেরার পর পাঁচটা গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন। ফেরার আগে কয়টা ছিল? ৩!

আনন্দ মিলিয়ে গেল দুঃস্বপ্নে

ভারতের জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন যুবরাজ। ছবি: টুইটার

'এই পথটা আমি চিনি। এই ব্যথাটা আমার জানা। জানি তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন। কিন্তু ভাগ্য কারও কারও পাশে থাকে, তাঁরা বেঁচে যান। আর কারও পাশে ভাগ্য থাকে না।'

বিরল ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে হার মেনে অভিনেতা ইরফান খান মারা যাওয়ার পর টুইটটা করেছিলেন যুবরাজ সিং। কে জানে, হয়তো নিজের কেমোথেরাপির দিনগুলো মনে পড়ছিল তাঁর। ইরফান খান কী কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছেন, তা হয়তো কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছিলেন যুবরাজ। কিন্তু ভাগ্য তাঁর পাশে ছিল।

ভারতকে তখনো দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতানোর আনন্দটা ঠিকভাবে উপভোগ করেছেন কি করেননি, যুবরাজের জীবনে ঝড় হয়ে এল দুঃস্বপ্ন সংবাদটা। বড় চ্যালেঞ্জের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো তাঁর অভ্যাস। সেটি ২০০০ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর প্রথম ব্যাট হাতে নামার দিন হোক বা টি-টোয়েন্টি-ওয়ানডে বিশ্বকাপে আলো ছড়ানো। তাঁর দারুণ অনেক পারফরম্যান্স ভারতকে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এনে দিয়েছে, এর মধ্যে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রডের এক ওভারে ছয় ছক্কার কথা কে ভুলতে পারে! উপমহাদেশেই আয়োজিত ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতকে শিরোপা এনে দেওয়ার পথে ব্যাটে-বলে বাজিমাত করে টুর্নামেন্টসেরার মুকুটই পরেছেন। তাঁর তো তখন গর্বে-প্রশংসায় ভাসার সময়। অথচ যুবরাজ ভাসলেন সমবেদনার বার্তায়। বিশ্বকাপের সাত মাস পর নভেম্বরে খবর এল, ভারতের বিশ্বকাপ নায়কের ফুসফুসে ব্যতিক্রমী এক টিউমার আছে। তিন মাস পর রাশিয়ার এক ডাক্তার জানালেন সেটি ক্যানসার। তবে সাধারণত ফুসফুসের ক্যানসার যেমন হয়, এটি তেমন নয়। যুবরাজের হয়েছিল সেমিনোমা, প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ায় যেটি থেকে বেঁচে ফেরার হার ৯৫ শতাংশ বলে জানা যায়। যুবরাজ অবশ্য পরে জানান, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময়ই তাঁর বমির সঙ্গে রক্ত গিয়েছিল। ওই অবস্থা নিয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন। সেরা হয়েছেন!

ক্রিকেটবিশ্বকে থমকে দেওয়া ওই খবরের সঙ্গে অবশ্য দ্রুতই মানিয়ে নিয়েছেন যুবরাজ। ২০১২ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় তাঁর কেমোথেরাপি। তিন ধাপের কেমোথেরাপি শেষে দেশে ফেরেন। ক্রিকেটে ফিরতে অবশ্য বেশি সময় নেননি। ক্যানসারকে পাশ কাটিয়ে কেমোথেরাপির ধকল সারিয়ে ভারতের জার্সিতে আবার তাঁকে মাঠে দেখা গেছে ২০১২ সালের আগস্টেই!

ক্যানসারের চিকিৎসার সময় যুবরাজ সিং। ছবি: টুইটার

ফেরার পর অবশ্য ব্যাট হাতে ধুকেছেন। মাঝেমধ্যে আলো ছড়ালেও আগের সেই ছন্দে আর ফিরতে পারেননি। দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। ২০১৭ সালের জুনেই শেষবার ভারতের জার্সিতে খেলেছেন।

তবে ক্যানসার জয় করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফেরা, ভারতের জার্সিতে ম্যাচ জেতা-জেতানো, এসব তো আছেই। যুবরাজের কাছে এর চেয়েও বেশি গুরুত্ব পায় অবশ্য অন্য দিকটি। জীবনের জয়গান! ২০১৩ সালে হিন্দুস্তান টাইমসে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর কথাগুলো যে কারও জন্যই হয়তো প্রেরণার, 'আমি এখন আগের চেয়ে বেশি নির্ভার। দেখুন, বয়স যখন কম থাকে, দেশের হয়ে খেলার ইচ্ছা থাকে, ভালো করতে থাকেন, তখন হয়তো কোনো বাধাকেই বাধা মনে হয় না। সে চোট হোক, বা ফর্মহীনতা। এটাতে হয়তো রাগ হতে পারে, বিরক্তি আসতে পারে, হতাশ হতে পারেন। কিন্তু যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হবেন, তখন হয়তো জীবনের আসল মূল্যটা বুঝতে পারবেন।'

সেই মূল্যটা কী, সেটাও একটা বড় শিক্ষা যুবরাজের কাছে, 'নিঃশ্বাস নেওয়া, খাবার উপভোগ করা, জীবনের ছোট ছোট আনন্দ, ছোট ছোট সহজ যে ব্যাপারগুলোকে আমরা পাত্তা দিই না, সেগুলোই তখন অমূল্য হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টায় আমার যখন দম বন্ধ হয়ে আসছিল, শারীরিক কষ্ট পাচ্ছিলাম, কেমোর সময়ে যখন কিছু খেয়েই হজম করতে পারছিলাম না, শারীরিক ও মানসিকভাবে যখন বিধ্বস্ত ছিলাম, তখন উপলব্ধি হলো, স্বাভাবিক জীবন আসলে একটা আশীর্বাদ। আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেই এমন ব্যাপারে মাথা নষ্ট করে এই ব্যাপারটাকে (স্বাভাবিক জীবন) নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।'

কে বলবে, একটা-দুটা বিশ্বকাপ জেতার চেয়ে এই উপলব্ধির মূল্য কোনো অংশে কম!