গ্রুপপর্ব শেষে গতিময় ও আক্রমণাত্মক ফুটবলের প্রশংসা করেছিলাম। তবে এটাও বলেছিলাম, শেষ ষোলোয় কৌশলের কাছে মার খেয়ে যেতে পারে আক্রমণাত্মক ফুটবল।
অবশ্য কৌশলী ফুটবল খেলে সফল হয়েছে মাত্র কয়েকটি দল। অন্যরা কী করেছে? গতিময় ফুটবল এই রাউন্ডেও ছিল, ছিল আক্রমণাত্মক ফুটবলও। সবচেয়ে বড় কথা হলো অনেকগুলো ম্যাচের ফল নির্ধারিত হয়েছে শেষ মুহূর্তে। আটটা ম্যাচের পাঁচটিই অতিরিক্ত সময়ে গড়াল। দুবার তো পেনাল্টি শুটআউটেই নির্ধারিত হলো ফল।
আগের বিশ্বকাপগুলোয় শেষ ষোলোতে একটা ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে তুষ নয় শুধু চালেরই জায়গা হতো। কিন্তু এবার কোস্টারিকা ও কলম্বিয়ার মতো দেশগুলো শুধু দ্বিতীয় রাউন্ডেই ওঠেনি, উঠে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালেও। অর্জনটা প্রশংসা করার মতোই।
আমার বিশ্বাস, এবার লাতিন দেশগুলো বিশ্বকাপে বেশ ভালো প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। তারা এতটা আন্তরিকতার সঙ্গে প্রস্তুতি সেরেছে যে চিলিকে টাইব্রেকারে হারানো ব্রাজিল এখন ভাবছে কলম্বিয়াকে নিয়েও। চিলি ম্যাচের পর ব্রাজিলিয়ানরা বিশেষ করে নেইমারের চোখে ঝরেছে একই সঙ্গে মুক্তি, আবেগ ও ক্লান্তির জল।
কলম্বিয়ার সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালের আগে ব্রাজিলকে তাদের খেলার ধরন নিয়ে আবার ভাবতে হবে। দলটার বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে উজ্জ্বল। তবে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে হলে শুধু ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে কাজ হবে না, জাত চেনাতে হবে পুরো দলকেই। ঘরের মাঠে নিজেদের দর্শকদের উৎসাহটাও সাহায্য করবে। আরেকটু উন্নতি করলেই শুধু ব্রাজিলিয়ানদের পক্ষে পরের বাধাটা পেরোনো সম্ভব। সম্ভব কলম্বিয়ার ২২ বছর বয়সী তারকা হামেস রদ্রিগেজ আর কোনো জাদু না দেখালে। উরুগুয়ের বিপক্ষে সে তো অসাধারণ এক শৈল্পিক গোল পেয়েছে।
জার্মানির জন্যও আলজেরিয়ার ম্যাচটা মোটেও সহজ হয়নি। আর যা-ই হোক এই ম্যাচের প্রথমার্ধে জার্মানি যা খেলেছে সেই খেলা খেলে ফ্রান্সের সঙ্গে পার পাওয়া যাবে না। এত অল্প দৌড়, এত ভুল পাস! দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য জার্মানরা খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, দেখার ছিল গোলটা কখন আসে। যদিও গোল পেতে অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
জার্মান দলটাকে নিয়ে যত বিতর্ক ও স্তুতি তার সবটাই কিন্তু আবার বায়ার্ন মিউনিখ গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যারকেন্দ্রিক। পেনাল্টি বক্সের বাইরে তাঁর পারফরম্যান্স জার্মানিকে পিছিয়ে পড়তে দেয়নি। কোনো কোনো সাংবাদিক নয়্যারের মধ্যে সেপ মায়ার (সাবেক জার্মান গোলরক্ষক) ও আমার সমন্বয় খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা যেটা বোঝাতে চেয়েছেন, পুরোনো লিবেরো অথবা সুইপার পজিশনের পুনর্জন্ম হয়েছে।
ব্যাপারটাকে আমি এভাবে দেখি—কোনোই সন্দেহ নেই যে প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করতে নয়্যারের জুড়ি নেই। কিন্তু আমি লিবেরো হিসেবে দেখতে চাই না। কারণ লিবেরোকে আমক্রমণেও উঠতে হয়। নয়্যারের পূর্বসূরি অলিভার কান তো নয়্যারের ওভাবে উঠে আসাটাকে হারা-কিরি বলেছে। পেনাল্টি বক্সের বাইরে যদি চার্জ করতে বিন্দুমাত্র দেরি হতো, নয়্যার লাল কার্ড পেতে পারত। তাকে নিশ্চিত হতে হবে প্রতিপক্ষের আগেই যেন সে বলটাকে ধরতে পারে।
আলজেরিয়ার চেয়ে ফ্রান্স বেশি শক্তিশালী, তবু আমার মনে হচ্ছে জার্মানির জন্য কোয়ার্টার ফাইনালটাই বেশি সহজ হবে। এর কারণ তারা ফরাসিদের খুব ভালো করে জানে। আরেকটা কারণ হচ্ছে প্রথম মিনিট থেকেই সবার মনোযোগই থাকবে ম্যাচ জয়ের দিকে।
মেক্সিকোর জন্য কেউ যদি অশ্রু ঝরায় তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। ব্রাজিলের সমান পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপপর্ব পেরোনো দলটি হল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্ভাগাই ছিল। শেষ কয়েক মিনিটে দুই গোল করে ডাচরা পার পেয়ে গেল। হল্যান্ডকে এখন কোস্টারিকাকে সামলাতে হবে। এবারের ডাচ দলটা এখন আর আগের মতো নিজেদের স্টাইল আঁকড়ে ধরে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে না। এবার দলটি খুব ঠান্ডা মাথায় কার্যকরী ফুটবল খেলছে।
সুইজারল্যান্ডের জন্য অশ্রু বরাদ্দ রইল। ওটমার হিজফেল্ডের বিদায়ী ম্যাচে দারুণ লড়েছে তাঁর দল। আর্জেন্টিনাকে হারানোর খুব কাছে চলে গিয়েছিল তারা। মেসিকে কী দারুণভাবেই না আটকে রাখল! ম্যাচটা অবশ্য হিজফেল্ডকে দুঃখই দিয়েছে। ১১৮ মিনিটে গোল খাওয়াটা মর্মান্তিক। এরপর তো দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলটা পোস্টে লাগল। এ ধরনের টুর্নামেন্টে ভাগ্যের ছোঁয়া কিছুটা হলেও দরকার। সুইসরা কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলে সেটা দারুণ হতো। ওটমারের জন্য এমন একটা উপহারই আমি আশা করেছিলাম। যদিও তাতে তাঁর বিদায়টা কিছুদিন পেছাতই শুধু।
অশ্রুর শেষ ফোঁটাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। কৌশলগতভাবে শক্তিশালী বেলজিয়ামের বিপক্ষে তারা দারুণ লড়েছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ২-১ গোলে হারলেও ক্লিন্সমানকে সফল বলতেই হচ্ছে। কারণ এনএফএল, বেসবল ও বাস্কেটবলে বুঁদ হয়ে থাকা একটা জাতিকে সে ফুটবল দেখতে বাধ্য করেছে, যার মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ছিলেন।