খেলোয়াড়দের হাত ধরে আছে সাদা পোশাক পরা একজন করে শিশু। খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাঁটি হাঁটি পা পা করে তারা চলে যেতে লাগল মাঠের মাঝখানে। কিন্তু বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সারির সবার শেষে দাঁড়ানো তামিম ইকবাল দেখলেন, তাঁর হাত ধরে রাখা শিশুটি ছাড়াও দাঁড়িয়ে আছে আরও দুটি শিশু। তামিম তাদের মন খারাপ হতে দিলেন না। একাই তিন শিশুর কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে থাকলেন মাঝমাঠের দিকে।
খেলার আগে শিশুদের সঙ্গটা বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ভালোই উপভোগ করলেন মনে হলো। মাঠের মাঝখানে সাকিব আল হাসানের সামনে দাঁড়ানো কন্যাশিশুটির চুলে আবার দুটি ঝুঁটি বাঁধা। সাকিব কী একটা বলে সেগুলো নিয়ে মজা করলেন পাশে দাঁড়ানো আল আমিনের সঙ্গে। আল আমিন হাসতে হাসতে শেষ।
এই দুটি বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচের দুটি আনন্দময় খণ্ডচিত্র। চাইলে মাঠ থেকে গ্যালারি হয়ে প্রেসবক্স পর্যন্ত এমন আরও খণ্ডচিত্র খুঁজে বের করা যেত। আনন্দের বন্যা যে সবখানে! আফগানিস্তানকে হারানোর আনন্দ নয়, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের রোমাঞ্চ গায়ে মাখার আনন্দ। আফগানিস্তানকে নিয়ে একটু শঙ্কা যে ছিল না, তা নয়। তবে ম্যাচের আগের দিনই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা ও মনোভাবে অনেকটা উড়ে গিয়েছিল সেটি। কাল তো ম্যাচ শেষে সাকিব আল হাসান বলেই দিলেন, তাঁরা আগেই জানতেন ম্যাচটা হেসেখেলে জিতবেন। আসলে ছেলেদের মেয়েদের মিলিয়ে ৬০ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ম্যাচ একবিন্দু শিশিরমাত্র। এই ম্যাচ জয় বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঠিকই, তবে কঠিন যে মোটেও ছিল না, তা কালকের খেলাতেই প্রমাণিত। বাংলাদেশে বিশ্বকাপের আনন্দময় অভিযাত্রায় সেটি বাড়তি একটু হর্ষধ্বনি দিল মাত্র।
বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই এখন গ্যালারিতে প্রচুর বাঘের ছড়াছড়ি। মোটর মেকানিক তরুণ শোয়েব আলী তো গায়ে বেঙ্গল টাইগারের ডোরাকাটা দাগ এঁকে শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়েতেও চলে গিয়েছিলেন! শোয়েব পথিকৃৎ, এরপর গ্যালারিতে ‘বাঘ’ এসেছে আরও। তাঁরা পতাকা উড়িয়ে, চিৎকার করে যতটা না খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করতে পারেন, তার চেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেন গ্যালারির দর্শক আর টিভি ক্যামেরাম্যানদের। কালও গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে সে রকম এক মানববাঘ এসে হাজির। ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ চিৎকারে খেলা শুরুর আগেই মাতিয়ে তুললেন গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড।
এই চিৎকার অবশ্য ম্যাচজুড়েই ছিল গ্যালারিতে। আফগানিস্তানের ব্যাটিংয়ের সময় তো ক্রমাগত উইকেট পড়ায় চিৎকারটা থামছিলই না। ৭২ রান তাড়া করা বাংলাদেশ ইনিংসে প্রতিটি মুহূর্তই কাটল জয়ের অপেক্ষায় আর ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ চিৎকারে। খেলা শেষে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার দেওয়ার সময় সেটি বদলে গেল ‘সাকিব’, ‘সাকিব’-এ। জয়ের আত্মবিশ্বাস থাকলেও সেই জয় যে এত সহজে ধরা দেবে, সেটা বোধ হয় সাকিবও অনুমান করতে পারেননি। ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি হাতে ধন্যবাদ দিলেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটকে, ‘উইকেটটা এমনিতেই ভালো, তবে আজ একটু অন্য রকম ছিল। আমি আমার জীবনের প্রতিটি দিনই এমনই উইকেটে বল করতে চাইব।’ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এমন শুরুটা সাকিবের ভাষায় ‘গ্রেট।’
বিশ্বকাপ বাংলাদেশ এর আগেও আয়োজন করেছে। তবে ২০১১ সালে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ছিল সহ-আয়োজক, খেলা হয়েছিল শ্রীলঙ্কা আর ভারতেও। কিন্তু এবার বাংলাদেশ একাই আয়োজক। ২০১১ বিশ্বকাপের সময় বিসিবি সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল এখন আইসিসির সহসভাপতি, সে সঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রীও। কাল খেলার একফাঁকে প্রেসবক্সে ঢুঁ মারা এই সাবেক বোর্ড সভাপতি তুলনা করলেন ২০১১ বিশ্বকাপের সঙ্গে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের, ‘আমি তো দুই বিশ্বকাপের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। সেবারের মতো এবারও সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হচ্ছে। আমার কাছে সবকিছু ভালোই মনে হচ্ছে।’
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের একটা দিনই গেল মাত্র। এখনই পুরো বিশ্বকাপ নিয়ে মন্তব্য করার সময় হয়তো আসেনি। তবে এটা বাংলাদেশ। বড় কোনো আসর আয়োজনের জন্য নোবেল জাতীয় কোনো পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে সেটাও বুঝি এত দিনে পেয়ে যেত এই দেশটা! ১৯৯৮ নকআউট বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ২০১১ বিশ্বকাপ—কম কিছু তো সফলভাবে আয়োজন করল না বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। আর এসবের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে জনসমর্থন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা মাঝে একবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভবিষ্যতের আকাশে কালো মেঘ জড়ো করলেও সেই আকাশে এখন নীল। গোটা দেশে ক্রিকেটের আবহ, দেশের মানুষ মেতেছে ক্রিকেটানন্দে। আগামী ২১টি দিন এ দেশের মানুষ শুধু ক্রিকেটই ভাববে, ক্রিকেটই ‘খাবে’, স্বপ্নও দেখবে ক্রিকেটই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয়টি সহজতম উপায়ে এসে যাওয়ার পর এটুকু ভবিষ্যদ্বাণী করার ঝুঁকি এখন নেওয়াই যায়।