যে কয়জন বিদেশি ফুটবলারের আগমনে একসময় রঙিন ছিল বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল, সে তালিকার ওপরের দিকেই থাকবে উজবেকিস্তানের স্ট্রাইকার আজামত আবদু রহিমভের নাম। ১৯৯২ সালে মোহামেডানের জার্সিতে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই ১২ ম্যাচে ১৭ গোল করে হয়েছিলেন ঢাকা লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। উজবেকিস্তান থেকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বাংলাদেশ অধ্যায়ের অনেক গল্পই বলেছেন ১৯৯৪ হিরোশিমা এশিয়ান গেমস ফুটবলে নিজের দেশকে সোনা এনে দেওয়ার নায়ক-
করোনাভাইরাস উজবেকিস্তানে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আপনি নিশ্চয়ই ভালো আছেন...
তাসখান্দে পরিবার নিয়ে ভালোই আছি। এখানে লকডাউন চলবে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। তবে ব্যক্তিগত বাহনে সকাল ৭টা থেকে ১০টা ও বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলাচল করা যায়।
অবসর নেওয়ার পরও তো কোচ হিসেবে ফুটবলের সঙ্গেই আছেন...
হ্যাঁ, আমি এএফসি ‘প্রো’ সনদধারী কোচ। ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত উজবেকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলের প্রধান কোচ ছিলাম। চলতি বছরের শুরুতে সেই দায়িত্বে ইস্তফা দিয়ে আপাতত একটা ক্লাবের যুবদলকে কোচিং করাচ্ছি। ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অবসর নেওয়ার পরও আমাকে উজবেকিস্তান জাতীয় ফুটসাল দলের হয়ে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এক বছর ফুটসাল দলের হয়ে খেলার পর সেই দলেরই কোচের দায়িত্ব নিই। এরপর বিভিন্নভাবে কোচ হিসেবে কাজ করে সর্বশেষ উজবেকিস্তান যুবদলের দায়িত্বে ছিলাম।
বাংলাদেশ আর মোহামেডানের কথা মনে পড়ে?
মোহামেডানে খেলার সময়ের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। ঢাকায় আমার দিনগুলো আনন্দময় ও ভালোবাসায় ভরপুর ছিল। দল হিসেবে আমরা খুব ভালো ছিলাম। কোচিং স্টাফরা ছিলেন বন্ধুত্বপূর্ণ। সমর্থকেরা ছিলেন অসাধারণ।
মোহামেডানের জার্সিতে ১২ ম্যাচে ১৭ গোল করেছিলেন। যেকোনো স্ট্রাইকারের জন্যই তো পরিসংখ্যানটা ঈর্ষণীয়...
দুর্ভাগ্য, সেবার মৌসুমের শুরু থেকে যোগ দিতে পারিনি। লিগ শুরুর পর আবাহনী থেকে পিছিয়ে পড়ে মোহামেডান। ১২ ম্যাচ খেলে ১৭ গোল করে আমি সর্বোচ্চ গোলদাতা হই। ম্যানেজার সালাম মুর্শেদী ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর ২৫ (সঠিক গোলের সংখ্যা ২৭) গোলের রেকর্ড ভাঙতে পারলে ৫ হাজার ডলার পুরস্কার দেবেন। কিন্তু ১২ ম্যাচে রেকর্ডটা ভাঙা কঠিন ছিল। পুরো মৌসুম খেললে হয়তো ভেঙে দিতামমোহামেডানের জার্সিতে ১২ ম্যাচে ১৭ গোল করেছিলেন। যেকোনো স্ট্রাইকারের জন্যই তো পরিসংখ্যানটা ঈর্ষণীয়...
অনেকের অভিযোগ, আবাহনীর বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে যাওয়া শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে আপনি নাকি ইচ্ছে করেই ভালো খেলেননি। ২৮ বছর পরে এসে সত্যটা কী, বলা যায়?
অন্য দুই বিদেশি বরিস কুজনেকভ ও সার্গেই নভিকভের সঙ্গে সেদিন আমারও লক্ষ্য ছিল ম্যাচটা জেতা। কিন্তু দল ভালো খেললেও আমি ভালো খেলতে পারিনি। শুরুতেই ব্যথা পাওয়ায় পুরো ম্যাচ ব্যথা নিয়েই খেলতে হয়। ম্যাচের আগে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটেছিল। ক্লাব কর্তৃপক্ষ কথা দিয়েছিল, ম্যাচের আগেই আমাদের টাকা বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু তারা কথা রাখেনি। আমরা মানসিক চাপে পড়ে যাই। শেষে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, আমরাও টাকা পাইনি।
রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বিরের সঙ্গে আপনার খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল। সাব্বির বা বাংলাদেশের অন্য খেলোয়াড়দের কেমন দেখেছেন?
সাব্বির ছিল বাংলাদেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। কৌশলী ও বুদ্ধিদীপ্ত খেলোয়াড় ছিল। আমি ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে পারলেও নিখুঁতভাবে গোল দিতে পারত। ওর সঙ্গে নভিকভেরও ভালো বোঝাপড়া ছিল। গোলরক্ষক কানন ও ডিফেন্ডার কায়সার হামিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। দলকে নেতৃত্ব দিতেন তাঁরাই।
বাংলাদেশের কোন স্মৃতিটা এখনো তাজা?
বাংলাদেশের পর আমি মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবেও খেলেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের স্মৃতিই আমাকে বেশি আনন্দ দেয়। যখন কোনো ভক্ত বার্তা পাঠিয়ে আমার ৩ ম্যাচে ১০ গোল (হ্যাটট্রিকের হ্যাটট্রিক করেছিলেন) ও এক ম্যাচে ৪ গোলের কৃতিত্ব মনে করিয়ে দেন, সেটা খুব ভালো লাগে। অনেকেই বলেন, বাংলাদেশে আমি যা করেছি, আমার পরে তা কেউ করতে পারেনি।
কোন স্মৃতিটা বেশি কষ্ট দেয়?
গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচে আমি হ্যাটট্রিক করে দলকে জিতিয়েছিলাম। ম্যাচ শেষে সমর্থকেরা আমাকে কাঁধে তুলে নেন। সে সময়ে কেউ একজন আমার গলার সোনার চেইনটি ছিঁড়ে ফেলেন। কে এটা করেছিলেন, জানা নেই। আসলে সমর্থকেরা তো অনেক পাগল ছিলেন।
উজবেকিস্তানের ফুটবলারদের মধ্যে আপনিই প্রথম দেশের বাইরের ক্লাবে খেলেন এবং সেটি মোহামেডানে। বাংলাদেশ থেকে ফিরে হলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক। আপনার ক্যারিয়ারে মোহামেডানের হয়ে খেলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
মোহামেডানে খেলার পর আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। উজবেকিস্তান জাতীয় দল গঠন করা হলে আমাকে অধিনায়ক করা হয়। মধ্য এশিয়ান কাপে ৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হই। ১৯৯৪ এশিয়ান গেমসে উজবেকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন হওয়াতেও আমার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।