বাংলাদেশের সেই প্রথম জয়

জিম্বাবুয়ের শেষ উইকেটের পতন! নিশ্চিত হয়ে গেল জয়!
জিম্বাবুয়ের শেষ উইকেটের পতন! নিশ্চিত হয়ে গেল জয়!

১০ জানুয়ারি ২০০৫। দুপুর ১২টা ৫৩।

উদ্বেগ, কৌতূহলস্পন্দিত বক্ষে সবাই তাকিয়ে চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের দিকে। ম্যাচ জিততে জিম্বাবুয়ের তখনো দরকার ২২৭ রান। তখনই, হ্যাঁ ঠিক তখনই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এনামুল হক জুনিয়রের বলে সিলি পয়েন্টে ক্রিস্টোফার পোফুর ক্যাচ ধরে মোহাম্মদ আশরাফুল দিলেন ভোঁ-দৌড়! মুহূর্তেই এম এ আজিজ স্টেডিয়াম পরিণত হলো উত্সবের মঞ্চে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে উত্সবের রং ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেশে। পাঁচ বছর দুই মাস, ৩১ পরাজয়, ৩টি ড্র আর অসংখ্য বিনিদ্র রাতের পর আরাধ্য জয়! বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়!

আজ সেই ১০ জানুয়ারি। ঠিক নয় বছর আগে, এই দিনে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বড় সাফল্য পেয়েছিলাম আমরা। সেদিন পরাজয় তো নয়ই, এমনকি ড্রয়ের জন্যও খেলেনি বাংলাদেশ; খেলেছিল কেবল জয়ের জন্য। ওই সময়ের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার গতকাল স্মৃতি তর্পণ করলেন এভাবে, ‘জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ শুরু হওয়ার আগে টিম মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জয়ের জন্যই খেলব আমরা। তখনো আমাদের টেস্ট ম্যাচের পরিসংখ্যানে জয়ের ঘরে “শূন্য” লেখা। খুব খারাপ লাগত দেখে। পরিকল্পনা ছিল, ঘরের মাটিতেই শূন্য মুছে ফেলতে চাই।’

জাতীয় পতাকা নিয়ে বাংলাদেশ দলের ল্যাপ অব অনার



৬ জানুয়ারি শুরু ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন হাবিবুল। কেন প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত, স্মৃতির ঝাঁপি খোলা হাবিবুল বললেন, ‘পরে ব্যাটিং করাটা একটু কঠিনই। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভালো একটা স্কোর করা। প্রথম ইনিংসেই বড় রান তুলতে পারলে আমাদের যেমন বোলিং করাটা সুবিধা হবে, তেমনি প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দেওয়া যাবে।’

প্রথমেই ব্যাট করতে নেমে দারুণ এক সূচনা এনে দিলেন ওপেনার জাভেদ ওমর ও নাফিস ইকবাল। জাভেদ স্মরণ করলেন ওপেন করার অভিজ্ঞতা, ‘এ টেস্টটি আমাদের জেতা খুবই জরুরি ছিল। জানতাম ভালো ব্যাটিং করতে পারলে ম্যাচে আমাদের অবস্থান অন্য পর্যায়ে চলে যাবে। নাফিসের সঙ্গে দারুণ একটা জুটি হলো শুরুতেই। ৯১ রানের ওই জুটি শক্ত একটি ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল দলকে।’ আরেক ওপেনার নাফিস ইকবাল বললেন, ‘টেস্ট সিরিজের আগেই আমাদের ওপর ভীষণ চাপ ছিল। কেননা ওই সময় একটা কথা বাতাসে ভাসছিল, এ সিরিজে যারা হারবে তাদের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে কথা উঠবে। আমাদের কাছে সিরিজ হারার পর কিন্তু জিম্বাবুয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্যি হয়েছিল!’

প্রথম ইনিংসে শতক থেকে মাত্র ছয় রান দূরে থেকে পোফুর বলে তাইবুর হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন দলপতি। এটা নিয়ে কতটা আক্ষেপে পুড়েছেন হাবিবুল? বর্তমান নির্বাচকের স্মৃতিচারণা, ‘আফসোস তো হচ্ছিলই। সেঞ্চুরি করলে ভালো হতো। দলের ইনিংসটা আরও বড় হতো!’ বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস ছিল অর্ধশতকময়! নাফিস করেছিলেন ৫৬, হাবিবুল ৯৪, রাজিন সালেহ ৮৯, মোহাম্মদ রফিক ৬৯। অল্পের জন্য অর্ধশতক ফসকে গিয়েছিল খালেদ মাসুদ (৪৯) ও মাশরাফি বিন মুর্তজার (৪৮)। মাশরাফির সেটি প্রথম ফিফটি হতো। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অতৃপ্তি নেই মাশরাফির, ‘ড্রেসিং রুম থেকে কোচ ডেভ হোয়াটমোর বার্তা দিয়েছিলেন মেরে খেলতে। কারণ তখন ইনিংস ঘোষণার ভাবনা ছিল। ফলে ফিফটির দিকে ওভাবে নজর ছিল না।’

প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয় ১৪৯.৩ ওভারে ৪৮৮ রানে। তখন সেটিই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় রান।

প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করতে নেমে মাশরাফি-তাপসের পেস আক্রমণ ও রফিকের ঘূর্ণি জাদুতে দিশেহারা জিম্বাবুয়ে। ১৫২ রানেই জিম্বাবুয়ের ৬ উইকেট হাওয়া! জিম্বাবুয়ের সামনে তখন ফলো-অনের চোখ রাঙানি। হাবিবুল বলেন, ‘জিম্বাবুয়ে ফলো-অনে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। আমাদের ভাবনা ছিল এমন, দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট না করতে পারলেই ভালো। কিন্তু ওদের অধিনায়ক তাইবু শেষ দিকে ভালো একটি ইনিংস (৯২) খেলল।’ আদতে তাইবুর প্রতিরোধে প্রথম ইনিংসে জিম্বাবুয়ের সংগ্রহ সব উইকেট হারিয়ে ৩১২। বাংলাদেশের পক্ষে রফিক নিলেন ৫টি, মাশরাফি ৩টি ও তাপস ১টি উইকেট।

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেই বিপর্যয়ে পড়ল বাংলাদেশ। এ অবস্থায় আবারও হেসে উঠল হাবিবুলের ব্যাট। হাবিবুল কিন্তু এগিয়ে রাখেন দ্বিতীয় ইনিংসের ৫৫ রানকেই। কেন? শুনুন তাঁর মুখেই, ‘স্ট্রাগলিং ইনিংস ছিল সেটা। ওই সময়ে প্রচণ্ড স্নায়ু চাপে খেলতে হয়েছে। কারণ পরিকল্পনা ছিল, দ্রুত বড় লক্ষ্য দিতে হবে জিম্বাবুয়েকে। আবার রান না করতে পারলে ইনিংসও ছাড়া যাচ্ছিল না। এসব টেনশনে উইকেট একটু দ্রুতই যাচ্ছিল। তবে লক্ষ্য করবেন, দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা রান তুলেছিলাম ৩.৯৮ গড়ে। প্রায় চারের কাছাকাছি।’

পায়ে ভীষণ ব্যথা পাওয়ার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছিলেন জাভেদ।  ওপেনিং অবশ্য নয়। ‘দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে পারব কি না, খানিকটা সংশয় ছিল। তবে মনের জোর ছিল প্রবল। তা ছাড়া আমরা ব্যাটিংয়ে বিপর্যয়েও পড়েছিলাম। এ কারণে সাত নম্বরে নেমেছিলাম’—জানালেন জাভেদ। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ উইকেটে ২০৪ করে ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫ উইকেট নেন এলটন চিগুম্বুরা। 

৩৮১ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমেই শুরুতেই পা হড়কাল জিম্বাবুয়ে। তাপসের বোলিং তোপে ৩.৪ ওভারে জিম্বাবুয়ের স্কোর—২ রানে ২ উইকেট! এটিকেই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট মানেন হাবিবুল। তাঁর জবাব, ‘চতুর্থ দিন বিকেলে পর পর দুটি উইকেট এনে দিয়েছিল তাপস (রজার্স ও সিবান্দার উইকেট)। তখনই ম্যাচের গতিপথ অনেকটা নির্ধারিত হয়েছিল। মানসিকভাবে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলাম আমরা।’

বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল সারা বাংলাদেশ

এবার বিজয়গল্পের বড় ক্লাইম্যাক্সটি শুনুন। টেস্টের চতুর্থ দিন পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি, কে হবেন ম্যাচের মূল নায়ক। পারফরম্যান্স বিবেচনায় সবার বাজি হাবিবুল কিংবা রফিকের পক্ষেই। কিন্তু ম্যাচের পঞ্চম দিনে সবাইকে তাক লাগিয়ে মঞ্চে আবির্ভাব এনামুল হক জুনিয়রের। এনামুল আলোয় ঝলকে উঠলেন এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। প্রথম ইনিংসে উইকেটশূন্য বাঁহাতি স্পিনার দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রানে তুলে নিলেন ৬ উইকেট। জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসের ঘাড় মটকাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন এনামুলই। সংগতকারণে তিনিই জয়ের নায়ক।

পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি ঝরানো এক জয় যেন পেল বাংলাদেশ! প্রথম টেস্ট বিজয়ের অনুভূতি আসলে কেমন? বাগ্মি হাবিবুলও ভাষা খুঁজে পেলেন না সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার, ‘সব অনুভূতিই তখন নতুন! প্রথম টেস্ট জয়ের অনুভূতি, প্রথম সিরিজ এগিয়ে যাওয়া, একপর্যায়ে প্রথমবারের মতো সিরিজ জিতে নেওয়া—সবকিছুই ছিল ‘‘প্রথম’’! এই প্রথমের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের নয়।’

মাশরাফি বললেন, ‘ওই ম্যাচের কথা মনে থাকবে সারা জীবন। তখন একটা জয়, অনেক বড় ব্যাপার আমাদের কাছে। ক্রিকেট যে পর্যায়েই যাক, প্রথম জয়ের কথা অবধারিতভাবে আসবেই।’ অনুপ্রেরণাদায়ী ম্যাচ প্রসঙ্গে নাফিসের মন্তব্য, ‘ওই সময় কিন্তু আমাদের চেয়েও জিম্বাবুয়ের রেকর্ড ভালো ছিল। এর পরও পুরো টেস্টে আধিপাত্য ধরে রেখে খেলেছি। এখনো ওই ম্যাচটি কথা ভীষণ অনুপ্রাণিত করে।’

ওই ম্যাচে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছিলেন প্রয়াত মানজারুল ইসলাম রানা। তাপসের বলে রজার্সের ক্যাচটি তালুবন্দী করেছিলেন রানা। অসীম শূন্যতায় পাড়ি জমানো রানাকে তাঁর অবদানের জন্য স্মরণ করতে ভুললেন না মাশরাফি, ‘স্কোয়াডে রানা ছিল। ওর কথা খুব মনে পড়ে।’ হাবিবুলও বললেন রানার কথা, ‘প্রথম একাদশে ছিল না, তবুও আমাদের সঙ্গেই ছিল। একই ড্রেসিং রুমে পাশেই ছিল। কত স্মৃতি ওর সঙ্গে!’

টেস্টে ক্রিকেটের পিচ্ছিল আঙিনায় বাংলাদেশের ইতিহাস নিরন্তর সংগ্রামেরই। ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতায় যোজন-যোজন এগিয়ে থাকা সব দলের বিপক্ষে হোঁচট খেতে খেতেই শিখছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় বাংলাদেশের উন্নতি আশাব্যঞ্জক। নিশ্চয়ই বহু স্মরণীয় জয় আসবে ভবিষ্যতেও। তবু প্রথম জয়ের কথা কি ভোলা যায়! স্মৃতিপটে তা নিপুণভাবে অঙ্কিত থাকবে কালে, মহাকালে।