মিরপুর স্টেডিয়ামকে অনেকেই আমার ‘খুব কাছের বন্ধু’ বলেন। হতে পারে! সে আমার বন্ধু। বয়সের পার্থক্যেও তো বন্ধু পাতানো যায়। ধরে নিন মিরপুর স্টেডিয়াম আমার বন্ধুই। কিন্তু বয়সে তো সে আমার অনেক ছোট। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে তিলে তিলে বেড়ে উঠেছি আমি। একসময় টিন দিয়ে ঘেরা হয়েছে আমার সীমানা। কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে আমার শরীর। সময়ের স্রোতে আমি পেয়েছি কংক্রিটের ছোঁয়া। আমি বেড়েছি ওপরের দিকে। একসময় আলোর বন্যা বইয়ে আমার বুকে আয়োজিত হয়েছে কত শত খেলা। দর্শকদের উন্মত্ত, উল্লাস আর আনন্দ আমাকে পরিপূর্ণ করে রেখেছিল। সে তুলনায় মিরপুরের জন্ম তো সোনার চামচ মুখে নিয়েই। আশির দশকে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেই সে সময়ের সরকার মিরপুরকে প্রথম ধাক্কাতেই এক আধুনিক স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত করেছিল। আলোর বন্যা মিরপুরের বুকে বইয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রথম থেকেই। ফ্লাডলাইটের চারটি টাওয়ার যেখানে আমাকে আলোকিত করছে, সেখানে মিরপুর স্টেডিয়ামের জন্মের সময়ই স্থাপন করা হয়েছিল ছয়টি টাওয়ার। টাওয়ারের সেই পার্থক্যে সে সময় মনে কিছু করিনি। আলো তো প্রায় পুরোটাই ছিল সে সময় আমার ওপর। মনে হয়েছিল মিরপুর না হয়ে দুটি টাওয়ার বেশি নিয়ে নিজেকে আলোয় রাঙাক! কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমাদের মধ্যে যে এত পার্থক্য তৈরি হবে, সেটা কি আমি ভেবেছিলাম!
আমাকে হিংসুটে ভাবছেন? দয়া করে এমনটি ভাববেন না। আমি বন্ধু মিরপুর স্টেডিয়ামকে অনেক ভালোবাসি। এই যে দুদিন আগেই তার বুকে ১০০টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হলো, আমি যে কী খুশি হয়েছি, সেটি বলে বোঝাতে পারব না। আমার বুকেও ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৫৮টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হয়েছে। আমি নিজের ইনিংসটাকে বড় করতে পারলাম না। ৫৮-তেই আটকে গেলাম। দোয়া করি মিরপুর যেন নিজের সেঞ্চুরিটাকে আরও বড় করতে পারে। ওর ডাবল সেঞ্চুরির উদ্যাপনটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
এই দেখুন, আমার মন খারাপ হবে না কেন! আন্তর্জাতিক ম্যাচ প্রসঙ্গে মনে পড়ল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি মিলিয়ে আমার বুকে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা কি ১০০ পেরোয়নি! ক্রিকেট আমার অবদান মনে রেখেছে। রেকর্ড বইয়ে জ্বলজ্বল করছে ৫৮টি ওডিআই আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলিয়ে ১৭টি টেস্ট ম্যাচের কথা। কিন্তু এই মাঠে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচগুলোর হিসাব কি আমার অভিভাবক বাফুফে বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ রাখে বা রেখেছে? ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দল ও মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল কয়টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আমার বুকে খেলেছে এ হিসাবটা জানতে বড় ইচ্ছা করছে। যোগ-বিয়োগ করে সে হিসাবটা ১০০ ছাড়িয়েও যেতে পারে। ভুলে গেছেন, লিওনেল মেসি, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, সার্জিও আগুয়েরো, গঞ্জালো হিগুয়েইন কিংবা হাভিয়ের মাচেরানোরা আমার বুকেই খেলে গিয়েছিলেন। নাইজেরিয়ার ওবি মিকেল, ভিনসেন্ট এনিমিয়াদের কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন। ২০০৬ সালে জিনেদিন জিদান হেঁটেছিলেন আমার বুকে। আমার অবস্থা আজ যতটা ফেলনা দেখছেন, আমি এতটা ফেলনা কিন্তু নই। আমার কষ্টটা একটা জায়গাতেই। আমি নিজের প্রাপ্য সম্মানটুকু কখনোই পেলাম না।
পুরোনো দিনগুলোর কথা আজ খুব করেই মনে পড়ছে। আমাকে নিয়ে দেশের শীর্ষ দুই খেলার কর্তাদের একসময় কী দড়ি টানাটানিইটা না হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেট মৌসুম শেষ হতে না হতেই ফুটবলের লোকজন আমার বুকে শাবল চালিয়ে বসত। নাহ, উদ্দেশ্য আমাকে হত্যা করা ছিল না। সেটা ছিল নিজেদের দখলদারিত্ব জানান দেওয়াই। ক্রিকেট পিচ খুঁড়ে ফেলে ফুটবল ফেডারেশন জানিয়ে দিত আগামী ছয় মাসের জন্য এই মাঠ আমার। মিরপুর স্টেডিয়াম সেই দিনগুলোর কথা মনে করে নিশ্চয়ই অলক্ষ্যে হেসে ওঠে। আজ আমার যে দশা, ২০ বছর আগে মিরপুরের দশা ছিল ঠিক তেমনই। গ্যালারির গায়ে শেওলা। মাঠ এবড়োখেবড়ো। আমিই যেন সে সময় ছিলাম ক্রীড়াঙ্গনের রঙ্গমঞ্চ। আমাকে না পেলে কিছুই হবে না—এমনই একটা ভাবনা ছিল সবার মধ্যে। আমাকে নিয়ে কেন এত দড়ি টানাটানি ছিল জানেন? সে সময় আমি ছিলাম ফুটবলের নিশ্চিত গেটমানির উৎস। লাখ, লাখ, কোটি, কোটি টাকা। একেবারে কাঁচা পয়সা। ক্রিকেটের গেটমানিটা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ওদের তো তখন মাঠই ছিল না। মনে আছে, একবার আমাকে না পেয়ে আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন, আমিনুল ইসলামের মতো তারকারা প্রেসক্লাবের সামনে ক্রিকেট খেলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তখন আমার ওপর আকরাম, আমিনুল, মিনহাজুলদের যেমন অধিকার ছিল, অধিকার ছিল রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, রিজভি করিম রুমি কিংবা মোনেম মুন্নাদের। সে সময়টা খুব যে খুশি লাগত, সেটা বলব না। বিরক্তই লাগত। স্বাধীন-সার্বভৌম একটা দেশের খেলাধুলা একটা স্টেডিয়ামে আবদ্ধ থাকবে, ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না।
এ শতকের শুরুর দিকে সমস্যাটার একটা স্থায়ী সমাধান হলো। সমাধানটা করে দিল ক্রিকেটই। ক্রিকেটের তখন রমরমা অবস্থার শুরু। বোর্ডের তহবিলে টাকার অভাব নেই। তারাই সরকারকে প্রস্তাব দিল মিরপুর স্টেডিয়ামটা ওদের দিয়ে দিতে। বাফুফে কর্তারা সে সময় হাঁপ ছেড়েই বেঁচে ছিলেন। তাঁরা স্বর্গসুখ অনুভব করেছিলেন, ‘যাক আপদ বিদেয় হলো। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামটা এখন পুরোপুরিই আমাদের।’ ক্রিকেটের জন্য কিছুটা মন খারাপ হলেও ব্যাপারটা একটা সমাধান হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে ক্রিকেটকে বিদায় জানালাম। দারুণ সেই বিদায়। আমার বুকে শেষ ম্যাচটায় বাংলাদেশ জিতেছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। মনে আছে? তখন তো জিম্বাবুয়েকে হারিয়েই আমরা বিশ্বজয়ের আনন্দ পেতাম। শেষ ম্যাচটার দিন হরতাল ছিল। কিন্তু আমার গ্যালারিতে দর্শকের কমতি ছিল না। কানায় কানায় ভরা দর্শক। তাদের সামনেই আফতাব আহমেদের সে কী মার! জিম্বাবুয়েকে উড়িয়েই দিয়েছিল সেদিন বাংলাদেশ।
ক্রিকেট মিরপুরে চলে যেতেই আমার বুকে কবরের নিস্তব্ধতা। ফুটবলে দর্শক কমতে লাগল। লিগের একেকটা ম্যাচ হয় আর সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশকের নস্টালজিয়া আরম্ভ হয়। সব দর্শকই চলে গেলেন ক্রিকেটে। আমার বুকে তখন থেকেই কেবল হাহাকার। মাঝেমধ্যে অবশ্য আমাকে খুব তোয়াজ করা হয়। ঝেড়ে-মুছে, রংটং মাখিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। আমি বুঝে যাই। নিশ্চয়ই বড় কোনো টুর্নামেন্ট বা ক্রীড়া উপলক্ষ আসন্ন। এককভাবে ফুটবলের হয়ে যাওয়ার পর রং মেখে রঙিন হয়েছি ২০০৬ সালের এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে। এরপর ২০১০-এর এসএ গেমসে। ২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা আমার বুকে খুব বড় আয়োজন। কিন্তু খারাপ লাগে ক্রিকেটের জন্য। ফুটবলের জন্যও খারাপ লাগে। ফুটবল নিয়ে আমার গ্যালারি মেতে ওঠা তো বিরল বিষয়েই পরিণত। এখন কালেভদ্রে একটু দর্শক হয়। লিগে গ্যালারি খাঁ খাঁ করে। শেষবার আমার গ্যালারি ভরে গিয়েছিল সেই ২০১৫ সালে, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ফাইনাল। অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন। কিন্তু আমি ভুলিনি।
মিরপুর এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট ভ্যেনু। কী গর্ব আমার বন্ধুর। মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিকদের কল্যাণে মিরপুরের মাঠ বারবার নেচে ওঠে ক্রিকেট-গৌরবে। আর আমি! চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি। কবে এ দেশের ফুটবলে প্রাণ ফিরবে। কবে আমার গ্যালারি একটু ভরে উঠবে। দর্শকদের উল্লাস আর উদ্যাপনে মিটে যাবে আমার তৃষ্ণা।
আমার বুকে কী না হয়েছে। ফুটবল, ক্রিকেট হকি—সবই। হকির মাঠ নয়। তবুও ১৯৮৫ সালে এখানে হয়েছে জমজমাট এশিয়া কাপ হকি। সে বছরেরই দ্বিতীয় সাফ গেমসের বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার বুকে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস। সাফ গেমসের পরও হয়েছে—১৯৯৩ সালে। টাট্টু শো, লেজার শো, কনসার্ট কী হয়নি আমার বুকে! আমার বুকে কতজন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া তারকা হেঁটেছেন, এই প্রজন্ম শুনলে অবাক হয়ে যাবে! কেবল খেলা আর কনসার্ট। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গেও তো আমি জড়িয়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরপর আমার বুকেই তাঁবু খাটিয়েছিল মুক্তিসেনার দল। মুক্তিযোদ্ধারা আমার বুকেই সমর্পণ করেছিল নিজেদের যুদ্ধকালীন অস্ত্র। মিত্র ভারতীয় বাহিনী আমার বুকেই কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ফিরে গিয়েছিল নিজেদের দেশে।
একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করি আক্ষেপগাথা। এই তো কিছু দিন ধরেই দেখছি আমার বুকে সবজির চাষ করছেন এক মাঠকর্মী। তা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি সোচ্চার! হ্যাঁ স্টেডিয়ামে সবজি চাষ কাজটি ভালো হয়নি। কিন্তু একবারেই কি ঘৃণা করার মতো কোনো কাজ? এই সবজি বেচে কি আর সেই মাঠকর্মী বড় ভবন বানিয়েছেন? কিংবা টাকার পাহাড় গড়েছেন? আমাকে ব্যবহার করেই তো কত ভুঁইফোড় টাকার কুমির হয়েছে। আমার সংস্কারের কাজ ঠিকমতো না করেই তো ঠিকাদার টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের লোকজনের দুর্নীতির কথা আজ না হয় না-ই বললাম। আহ, সবজি চাষের এই সমালোচনাকারীরা যদি মাঠে এসে আমাকে এক দিন উৎসাহ দিতেন!
প্রথম আলোতে দেখলাম, জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক টাটেন্ডা টাইবু আমাকে একবার দেখতে চেয়েছেন। আমার শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার আগে একজন তো অন্তত আমার নাম নিল। এই বা কম কি! তবে বিশ্বাস করুন, আমার আরও অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে। অন্তত দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসটা নতুন প্রজন্মকে জানাতেও তো আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি মরে গেলে সেই ইতিহাসও যে হারিয়ে যাবে অনন্ত অম্বরে। সেটা কি উচিত হবে?