ইউরোপিয়ান ফুটবলের ঘরোয়া মৌসুম শেষ হলো মাত্র। ক্লাবগুলোয় চলছে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি ও হতাশার খেরোখাতা মেলানোর আয়োজন। যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য থাকবে ভবিষ্যতেও এই সাফল্য ধরে রাখা। অতীতের ব্যর্থতা ভুলে নতুন মৌসুমের জন্য আবারও আশায় বুক বাঁধবে ব্যর্থ ক্লাবগুলো। এসব হিসাব-নিকাশের বেড়াজালে এ বছর আলোর ছটা হয়ে ফুটবল বিশ্বে এসেছেন বেশ কিছু আনকোরা তারকা, যাঁদের নিয়ে স্বপ্ন দেখছে ক্লাবগুলো। আশা করছে, ভবিষ্যতের মেসি-রোনালদো, রামোস-সালাহ, ডি ব্রুইনা-ফন ডাইকরা হয়তো এদের মাঝখান দিয়েই বেরিয়ে আসবেন!
কারা তাঁরা? আসুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
পেদ্রি
দেশ: স্পেন
ক্লাব: বার্সেলোনা
বয়স: ১৮
পজিশন: মিডফিল্ডার
লাস পালমাসে যখন খেলতেন, তাঁকে ‘নতুন ইনিয়েস্তা’ ডাকা হতো। ইনিয়েস্তা যে ক্লাবে তারকা হয়েছিলেন, সে ক্লাবও পেদ্রিকে পেতে দেরি করেনি। পেদ্রি এখন বার্সেলোনার মিডফিল্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেভাবে বুসকেতস ও ডি ইয়ংদের সঙ্গে মাঝমাঠ সামলান, মনে হয় কতই–না অভিজ্ঞ তিনি! এবার সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫২ ম্যাচ খেলেছেন পেদ্রি। ডাক পেয়েছেন ইউরোতেও।
দুসান ভ্লাহোভিচ
দেশ: সার্বিয়া
ক্লাব: ফিওরেন্তিনা
বয়স: ২১
পজিশন: স্ট্রাইকার
২১ বছর বয়সী এই সার্বিয়ান স্ট্রাইকার ফিওরেন্তিনায় গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা ও লুকা টনিদের মতো কিংবদন্তি স্ট্রাইকারের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছেন এবার। ২১ গোল করেছেন, তবে নজরে পড়েছে তাঁর গোল করার ধরণ। প্রথাগত স্ট্রাইকারদের মতোই গোল করার নেশা তাঁর। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের আর্লিং হরলান্ডের মতো উইং বা মাঝমাঠে নেমে খেলার অত বাতিক নেই। আর্সেনাল, এসি মিলান, এএস রোমা, ইন্টার মিলানের মতো ক্লাবগুলো এর মধ্যেই ভ্লাহোভিচকে চাইছে।
রিস উইলিয়ামস
দেশ: ইংল্যান্ড
ক্লাব: লিভারপুল
বয়স: ২০
পজিশন: সেন্টারব্যাক
লিভারপুলের মূল তিনজন সেন্টারব্যাক-ভার্জিল ফন ডাইক, জো গোমেজ ও জল মাতিপের চোটে পড়েছিলেন, না হয় রিস উইলিয়ামসকে হয়তো গত মৌসুমের মতো ইংলিশ ফুটবলের ষষ্ঠ পর্যায়ে ফুটবল খেলেই কাটাতে হতো। গত মৌসুমে ষষ্ঠ পর্যায়ে খেলা এই আনকোরা ডিফেন্ডারই আজ লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
ওয়েসলি ফোফানা
দেশ: ফ্রান্স
ক্লাব: লেস্টার সিটি
বয়স: ২০
পজিশন: সেন্টারব্যাক
বর্তমান সময়ে ফ্রান্সের মতো অন্য কোনো দেশ হয়তো ফুটবলকে এত বেশি কার্যকরী ডিফেন্ডার উপহার দিচ্ছে না। এই নতুন ফরাসি সেন্টারব্যাক তালিকারই সর্বশেষ সংযোজন ওয়েসলি ফোফানা। এসেই লেস্টার সিটির রক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছেন, মৌসুম শেষে হয়েছেন ক্লাবের বর্ষসেরা যুব খেলোয়াড়। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে ভারান-লংলেকে হটিয়ে এই ফোফানা জাতীয় দলে খেললে অবাক হবেন না যেন!
সভেন বটম্যান
দেশ: নেদারল্যান্ডস
ক্লাব: লিল
বয়স: ২১
পজিশন: সেন্টারব্যাক
২১ বছর বয়সী এই সেন্টারব্যাককে এর মধ্যেই স্বদেশি ভার্জিল ফন ডাইকের সঙ্গে তুলনা দেওয়া হচ্ছে। বাঁ পায়ের এই খেলোয়াড় বাতাসে উড়ে আসা বল সামলাতে বেশ দক্ষ, ঠান্ডা মাথায় আগে থেকেই বিপদ আঁচ করতে পারেন। এবার লিগ শিরোপার দৌড়ে লিল যে পিএসজিকে হারাল, তার পেছনে এই বটম্যানের অবদান অনেক।
ফ্লোরিয়ান উইর্টজ
দেশ: জার্মানি
ক্লাব: বায়ার লেভারকুসেন
বয়স: ১৮
পজিশন: মিডফিল্ডার
চেলসির কাছে কাই হাভার্টজকে বিক্রি করে দেওয়ার পর তাঁর কোনো বিকল্প কেনেনি বায়ার লেভারকুসেন। কেন কেনেনি, সেটা নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠলেও লেভারকুসেন সেসব প্রশ্ন থামিয়ে দিয়েছে ফ্লোরিয়ান উইর্টজের কারণে। গত বছর লকডাউনের মধ্যে এই আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন দলতার কোচ পিটার বশচ। ফলাফল? বুন্দেসলিগার ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী গোলদাতা এখন এই উইর্টজ। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এই মৌসুমে ৩৮ ম্যাচ খেলে আটটি গোল ও অ্যাসিস্ট করেছেন।
ফাবিও সিলভা
দেশ: পর্তুগাল
ক্লাব: উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স
বয়স: ১৮
পজিশন: স্ট্রাইকার
মূলত ‘নতুন রোনালদো’ হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। উলভারহ্যাম্পটনের মতো দল তাঁর পেছনে যখন সাড়ে তিন কোটি ইউরো খরচ করল, তখনই পরিষ্কার হয়েছিল, এই ছেলের মধ্যে কিছু একটা আছে। চোটে আক্রান্ত মেক্সিকান স্ট্রাইকার রাউল হিমেনেজের জায়গায় এবার বেশ সুযোগ পেয়েছেন এই পর্তুগিজ, তেমন গোল করতে না পারলেও দেখিয়েছেন উন্নতির এখনও সুযোগ আছে অনেক তাঁর খেলার মধ্যে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এবার ৩৭ ম্যাচে ছয় গোল করেছেন, গোল করা ছাড়াও আক্রমণভাগের যেকোনো জায়গায় খেলেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে।
জামাল মুসিয়ালা
দেশ: জার্মানি
ক্লাব: বায়ার্ন মিউনিখ
বয়স: ১৮
পজিশন: স্ট্রাইকার
চেলসি তাঁর দাম বোঝেনি। চেলসির লোকসানই এখন বায়ার্ন মিউনিখের অন্যতম বড় অর্জন, অন্তত জামাল মুসিয়ালার খেলার দেখে এখন পর্যন্ত এমনটাই মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই প্যারাগুয়ের কিংবদন্তি রকি সান্তা ক্রুজকে টপকে বায়ার্ন মিউনিখের কনিষ্ঠতম গোলদাতা হয়েছেন। কিছুদিন আগেই ইংল্যান্ডের ডাকে সাড়া না দিয়ে জার্মানির হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া মুসিয়ালা স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার পাশাপাশি খেলতে পারেন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবেও। এর মধ্যে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৯ ম্যাচ খেলে ৭ গোল করা হয়ে গেছে তাঁর। জার্মানির ইউরো দলেও ডাক পেয়েছেন।
ইলাইশ মরিবা
দেশ: স্পেন
ক্লাব: বার্সেলোনা
বয়স: ১৮
পজিশন: মিডফিল্ডার
বার্সেলোনার বিখ্যাত ‘লা মাসিয়া’র হয়ে খেলার সময়ই কেন তাঁকে নিয়মিত পল পগবার সঙ্গে তুলনা করা হতো, সে প্রমাণ ইলাইশ মরিবা এই বছর দিয়েছেন। মরিবার চুক্তিতে ১০ কোটি ইউরোর বাইআউট ক্লজ কেন ঢুকিয়েছে বার্সেলোনা, প্রমাণ হয়েছে সেটাও। লিগে এবার ১৪ ম্যাচ খেলেছেন, মেসির সহায়তায় একটা গোলও পেয়েছেন এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। মরিবার এই দুর্দান্ত উন্নতি দেখেই লিভারপুল থেকে ডাচ্ মিডফিল্ডার জর্জিনিও ভাইনালদামকে আনার ব্যাপারে দুবার ভাবছে বার্সা।
ব্রায়ান গিল
দেশ: স্পেন
ক্লাব: এইবার
বয়স: ২০
পজিশন: মিডফিল্ডার
স্পেনের অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলা ব্রায়ান গিলকে এর মধ্যেই ‘নতুন নেইমার’ বলা হচ্ছে। এবার সেভিয়া থেকে ধারে এসেছেন এইবারে। ১৪ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৩টি। তাঁর ওপরে মূলত নজর পড়েছে বার্সেলোনার বিখ্যাত জহুরি জার্মান ভায়া বায়াব্রিগার। যার কারণেই বার্সেলোনা পেয়েছিল আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে। বার্সেলোনার ইতিহাসে এরই মধ্যে নাম লিখিয়ে ফেলা আনসু ফাতিও বায়াব্রিগার কারণেই লা মাসিয়ায় জায়গা পেয়েছেন।
ইউনুস মুসা
দেশ: যুক্তরাষ্ট্র
ক্লাব: ভ্যালেন্সিয়া
বয়স: ১৮
পজিশন: মিডফিল্ডার
সুযোগ ছিল আর্সেনালের একাডেমিতে আলো ছড়ানোর। কিন্তু মুসা মূল একাদশের অংশ হতে চেয়েছিলেন আগেভাগেই। ভ্যালেন্সিয়াও তাঁর আশা পূরণ না করে থাকেনি। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এবার ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন এই মিডফিল্ডার। যুক্তরাষ্ট্রও তাঁকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধছে, জাতীয় দলের জন্য।
জুড বেলিংহাম
দেশ: ইংল্যান্ড
ক্লাব: বরুসিয়া ডর্টমুন্ড
বয়স: ১৭
পজিশন: মিডফিল্ডার
করোনা পরবর্তী দলবদলের বাজারে ডর্টমুন্ডের মতো ক্লাব যখন মাত্র ১৭ বছর বয়সী কারওর জন্য আড়াই কোটি পাউন্ডের মতো খরচ করে, সেটাই জুড বেলিংহামের প্রতিশ্রুতি বুঝিয়ে দেয়। বার্মিংহাম সিটির হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে পেশাদার ম্যাচ খেলা ও গোল করার রেকর্ড তার। এখন আলো ছড়াচ্ছেন ডর্টমুন্ডে। এর মধ্যেই লিভারপুল, ইউনাইটেডের মতো ক্লাবগুলো তাঁকে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জিয়াকোমো রাসপাদোরি
দেশ: ইতালি
ক্লাব: সাসসুয়োলো
বয়স: ১৮
পজিশন: স্ট্রাইকার
ইতালির হয়ে বয়সভিত্তিক প্রত্যেকটা দলে আলো ছড়ানো ১৮ বছর বয়সী সাসসুয়োলোর এই স্ট্রাইকার এই মৌসুমে ২৭ ম্যাচ খেলে করেছেন ছয় গোল। গোলের সংখ্যা অতো বেশি না হলেও ইতালির কোচ রবের্তো মানচিনি ঠিকই পাকা জহুরির মতো জিয়াকোমো রাসপাদোরির মাঝে খুঁজে পেয়েছেন সম্ভাবনা। নাহয় ইউরোর প্রাথমিক স্কোয়াডে ডাকবেন কেন?
এরা ছাড়া আরও যাঁরা আলো ছড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—
উরোস রাকিচ (সার্বিয়া, ভ্যালেন্সিয়া, মিডফিল্ডার)
এবেরেচি এজে (ইংল্যান্ড, ক্রিস্টাল প্যালেস, মিডফিল্ডার)
ইমানুয়েল ভিনিয়াতো (ইতালি, জেনোয়া, মিডফিল্ডার)
নিকোলাস দমিঙ্গেস (আর্জেন্টিনা, বোলোনিয়া, মিডফিল্ডার)
রোনালদ আরাউহো (উরুগুয়ে, বার্সেলোনা, সেন্টারব্যাক)
তারিক ল্যাম্পটি (ইংল্যান্ড, ব্রাইটন অ্যান্ড হোভ আলবিওন, রাইটব্যাক)
অস্কার মিঙ্গেসা (স্পেন, বার্সেলোনা, সেন্টারব্যাক)
ফেদেরিকো দিমার্কো (ইতালি, হেল্লাস ভেরোনা, লেফটব্যাক)