ক্রিস্টিয়ান কারেম্বু : এই ট্রফিটা দেখলেই অনেক স্মৃতি ভিড় করে তাঁর মনে
ক্রিস্টিয়ান কারেম্বু : এই ট্রফিটা দেখলেই  অনেক স্মৃতি ভিড় করে তাঁর মনে

ক্রিস্টিয়ান কারেম্বুর সাক্ষাৎকার

ফাইনাল হবে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যে, মেসি বনাম এমবাপ্পে

ফ্রান্সের সোনালী প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি তিনি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর ২০০০ ইউরো ও ২০০১ কনফেডারেশন কাপজয়ী জিনেদিন জিদানের সেই সর্বজয়ী ফ্রান্স দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছেন দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগও। কোকা–কোলার আয়োজনে ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফির বিশ্ব পরিভ্রমণের সঙ্গী হয়ে বাংলাদেশে আসা ক্রিস্টিয়ান কারেম্বুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল শুভ্র।

উৎপল শুভ্র: আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই বলে দিচ্ছি, ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয় আপনার জীবনের স্মরণীয়তম অধ্যায়। বিশ্বকাপ ট্রফির সঙ্গে এই ওয়ার্ল্ড ট্যুর নিশ্চয়ই অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে মনে...

ক্রিস্টিয়ান কারেম্বু: অবশ্যই, অবশ্যই অনেক স্মৃতি ভিড় করছে মনে। ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি জেতাটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার। সেই ছোট্টটি থাকতেই তো স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়ার, একসময় জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন। অনেক পরিশ্রম, অনেক ত্যাগের পর নিজেদের দেশে স্তাদ দো ফ্রান্সে এই ট্রফি হাতে নেওয়ার সেই আবেগময় মুহূর্তটা আমার মনে চিরন্তন হয়ে আছে। যখনই ট্রফিটা দেখি, আমার পুরো জীবনটাই যেন দেখতে পাই। সেই বালকবেলা থেকে বিশ্বকাপ জয় পর্যন্ত যাত্রাপথটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

শুভ্র: যে ফ্রান্স এর আগে কখনো বিশ্বকাপ জেতেনি, প্রত্যাশার বিশাল চাপ সামলে সেই ফ্রান্সকেই দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন আপনারা...

কারেম্বু: আমাদের জন্য ওই বিশ্বকাপ সব দিক থেকেই নতুন। এভাবে বলা যায়, এর আগে আমার কাছে বিশ্বকাপ মানে ছিল সাদা-কালো পর্দায় দেখা কিছু ছবি, যা রাতারাতি রঙিন হয়ে গেল। প্যারিসে ফাইনাল, নতুন স্টেডিয়াম...মিশেল প্লাতিনি বিশ্বকাপ আয়োজক হিসেবে দারুণ কিছু করতে চেয়েছিলেন। আমাদের জয়ের মাধ্যমে সেটি পূর্ণতা পেয়েছিল। ফ্রান্সের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছিলাম। যদিও শুরুতে আমরা এতটা ভাবতে পারিনি। এক একটা ধাপ পেরোলাম আর টের পেতে থাকলাম মানুষের উন্মাদনা। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে মানুষ। হাতে পতাকা নিয়ে সমর্থকেরা আমাদের বাসের পেছনে দৌড়াচ্ছে। প্যারিসের অনেক বাইরে আমাদের অনুশীলন ক্যাম্প, সেখানে সব সময় মানুষের ভিড়। কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে আমরা যখন বেরোলাম, দেখলাম, সবার হাতে হাতে ফ্রান্সের পতাকা মিলে নীল একটা ঢেউ হয়ে গেছে, সেই ঢেউ অনুসরণ করছে আমাদের। আমরা অনেকে স্পেনে খেলতাম, অনেকে ইতালিতে, সেখানে আমরা ফুটবল নিয়ে এমন পাগলামি দেখেছি। কিন্তু ফ্রান্সে এমন কিছু দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না আমাদের। তখনই আমরা উপলব্ধি করলাম, অবশেষে আমরা বড় কিছু করছি। সবাইকে একতাবদ্ধ করছি। মনে হচ্ছিল, ফ্রান্সের মানুষ আর আমরা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছি।

ক্রিস্টিয়ান কারেম্বুর সঙ্গে উৎপল শুভ্র। গতকাল সকালে র‍্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে

শুভ্র: আপনাদের জন্য এটা একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা ছিল বলছেন?

কারেম্বু: হ্যাঁ, একেবারেই নতুন। একটা কারণ ছিল, এর আগে বিশ্বকাপে ফ্রান্সের তো তেমন কোনো সাফল্য ছিল না। অন্য ফুটবল দেশগুলোর অনেক বেশি সাফল্য। উদাহরণ হিসেবে ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের কথা ধরুন...এত সফল একটা দল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম সাফল্য পেয়ে এসেছে ওদের জাতীয় দল...যে কারণে ব্রাজিলের জাতীয় দল সত্যিকার অর্থেই ব্রাজিলের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। সেই ব্রাজিলকে ফাইনালে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতাটা ছিল দারুণ ব্যাপার। তবে আমরা কিন্তু খুব বিনয়ী ছিলাম, ওদের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। কারণ, আমরা জানতাম, ফুটবল–জাতি হিসেবে ব্রাজিল কোথায়।

শুভ্র: ১৯৯৮ সালের ওই বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা উঠলে প্রথমেই আপনার কী মনে পড়ে?

কারেম্বু: প্রথমেই মনে পড়ে আমার পরিবারের কথা। তাদের সবাইকে স্তাদ দো ফ্রান্সে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সবাই উড়ে এসেছিল ২০ হাজার কিলোমিটার দূরের নিউ ক্যালিডোনিয়া থেকে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দলের সঙ্গেই তারা সবাই উদ্‌যাপন করেছে। এই আনন্দ আমি কখনো ভুলব না। আমার কথা হয়তো একটু স্বার্থপরের মতো শোনাচ্ছে। উদ্‌যাপন তো আসলে সবাই করেছিল। এমনকি ফ্রান্সের বাইরের মানুষও। আমার মনে আছে, সঁ লিঁজে মানুষ আর মানুষ। যাদের অনেকের হাতে অন্য দেশের পতাকাও দেখেছি। এত এত মানুষ ছিল যে আমাদের বাস নড়তেই পারছিল না। পুলিশও কিছুই করতে পারছিল না। আমরা তাই প্যারেড বন্ধ করে এফএতে (ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশন) ফিরে গিয়েছিলাম।

১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোসের সঙ্গে ক্রিস্টিয়ান কারেম্বুর বলের লড়াই

শুভ্র: ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর ২০০০ ইউরো, এরপর ২০০১ কনফেডারেশন কাপ...ফ্রান্সের ফুটবলের সোনালি সেই প্রজন্মের একজন আপনি। ওই দলটা কোথায় আলাদা ছিল?

কারেম্বু: প্রথমেই বলব, টিম স্পিরিট। আমরা অনেকেই অনেক দেশে খেলতাম। জিদান জুভে, দেশমও জুভে, আমি মাদ্রিদে, দেশাই মিলান, ব্লাঁ বার্সেলোনা, জরকায়েফ ইন্টার মিলান...অনেকে খেলত ফ্রান্সে। আমরা সবাই সবার ভিন্ন অভিজ্ঞতাকে এক করেই জাতীয় দলকে গ্রেট বানিয়েছিলাম। ব্রাজিল যেমন সব শ্রেণির মানুষকেই ফুটবলে টেনে আনে, আমরাও সেবার তা-ই করতে পেরেছিলাম।

শুভ্র: জিদানের কথা তো আগে-পরে আসতই...আপনি যখন নামটা বললেন, প্রশ্নটা করেই ফেলি। মাঠে জিদানকে দেখে দর্শকের মতো আপনিও কি কখনো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতেন?

কারেম্বু: জিদান...ওয়াও...আমি বলব জাদুকরি প্রতিভা। বল নিয়ে ও যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারত। ওর কাছে আমাদের যা প্রত্যাশা ছিল, ফাইনালে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ২টি গোল করে তা পুরোপুরি মিটিয়ে দিয়েছিল। ফুটবল ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন, বড় খেলোয়াড়েরা আসল সময়ে পার্থক্য গড়ে দেয়। জিজু ছিল অসাধারণ...আশা করি, নতুন প্রজন্মও এই সাফল্যের ধারাকে টেনে নিয়ে যাবে। চার বছর আগে আমরা জিতেছি, আশা করি কাতারেও জিতব।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে জিদান, ১৯৯৮ সালে

শুভ্র: ১৯৯৮ ও ২০১৮ বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সের দুই দলের মধ্যে যদি তুলনা করতে বলি...

কারেম্বু: আসলে এভাবে তুলনা হয় না। দুটি ভিন্ন প্রজন্ম। ওদের জিদান নেই, আমাদের আবার এমবাপ্পে ছিল না। আমাদের থিয়েরি অঁরি ছিল, ওদের থিয়েরি অঁরি নেই। আমাদের প্রজন্মে এক-দুই-তিন, হয়তো চারজন ভালো স্কোরার ছিল। ত্রেজেগে-অঁরি-গিভার্চ...বলেই অবশ্য মনে হচ্ছে, এখনকার দলেও তো এমবাপ্পে, জিরো, গ্রিজমান, বেনজেমা আছে। আমার মনে হয়, এভাবে তুলনা না করে আমাদের প্রতিটি দল, প্রত্যেক খেলোয়াড়কেই সম্মান করা উচিত। তবে হ্যাঁ, আমি দুই দলের একটা পার্থক্যের কথা বলতে পারি—আমাদের ছিল আইমে জ্যাক (১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্স দলের কোচ), ওদের আছে দিদিয়ের দেশম (ফ্রান্সের বর্তমান কোচ), যে আবার আইমে জ্যাকের ছাত্র (হাসি)।

শুভ্র: ১৯৯৮ ফাইনালের কথা বললে সবার আগে হয়তো জিদানের হেডে ২ গোলই মনে পড়ে, এর বাইরে কিছু...

কারেম্বু: জিদানের ২ গোল তো অবশ্যই, তবে ইমানুয়েল পেঁতির শেষ গোলটাও। আপনার হয়তো মনে আছে, খেলাটা কিন্তু একসময় আমাদের ১০ জনের বিপক্ষে ওদের ১১ জনের হয়ে গিয়েছিল। দেশাই লাল কার্ড দেখায় শেষ ১৫ মিনিট পেঁতিকে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে হয়েছিল। ওখান থেকে উঠে গিয়ে ও গোলটা করেছিল। সেমিফাইনালে যেমন করেছিল (লিলিয়ান) থুরাম। ওই ২ গোলই তো আমাদের ফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল।

শুভ্র: জিনেদিন জিদান যে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন, এটা কি আপনি জানতেন?

কারেম্বু: কী, ২০০৬ সালে...বিশ্বকাপের আগে না পরে?

শুভ্র: বিশ্বকাপে ওই ঢুঁস–কাণ্ডের পরেই...ঢাকার কাছে একটা গ্রামে গিয়েছিলেন জিদান, সেখানে একজন মহিলা জিদানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ’তুমি অমন ঢুঁস মেরেছিলে কেন?’ আপনি তাহলে জানতেন না যে, জিদান বাংলাদেশে ঘুরে গেছেন।

কারেম্বু: না, জানতাম না। কেন এসেছিলেন?

শুভ্র: ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু নয়। একটা পণ্যের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে।

কারেম্বু: অ্যাডিডাস?

শুভ্র: না, একটা দুগ্ধজাত পণ্য। (কাছেই বসে থাকা ফিফার প্রতিনিধি এ সময় উঠে এসে সাক্ষাৎকারটা শুধু ট্রফি ট্যুর ও বিশ্বকাপে সীমাবদ্ধ রাখার কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন)

শুভ্র: জিদানের সঙ্গে তো কথা হয়নি, তাহলে এখানে আসার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনি কতটা জানতেন?

কারেম্বু: আমি শুধু এখানকার পোশাকশিল্প সম্পর্কেই জানতাম। আর জানতাম জনসংখ্যা সম্পর্কে। বাংলাদেশে তো ১৭ কোটি মানুষ, তা–ই নয়? ওয়াও! গ্রিসের মতো অনেক দেশ আছে, যাদের জনসংখ্যা এক কোটির মতো। যার মানে এর চেয়ে প্রায় ২০ গুণ মানুষ বাংলাদেশে বাস করে। অবিশ্বাস্য! আরও জানতাম, বাংলাদেশ ১০০ বছর আগে স্বাধীনতা পেয়েছে...১০০ না ৫০?

শুভ্র: ৫০ বছর..

কারেম্বু: ও হ্যাঁ, জাতির পিতার জন্মের ১০০ বছর, স্বাধীনতার ৫০ বছর। পাকিস্তান থেকে এখানে এসেছি বলে এসব জানতে পেরেছি। এখানে আসার পরও কিছুটা জেনেছি। বই পড়ে ইতিহাস জানার চেয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তা জানা ভালো।

বিশ্বকাপ ট্রফির সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছেন কারেম্বু

শুভ্র: কিন্তু এখানে আসার পর কোকাকোলার মানুষজনের বাইরে কি কারও সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে?

কারেম্বু: ইয়েস, ইয়েস...যেমন মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছে। দুজনই আমাকে এখানকার মানুষের ফুটবল নিয়ে উন্মাদনার কথা বলেছেন। বিশ্বকাপের সময় এই দেশের প্রত্যেকেরই নাকি নিজের দল থাকে। মাঝেমধ্যে মারামারিও হয়। এটা অবশ্য ঠিক নয়। ফুটবল তো শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম।

শুভ্র: কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্স আবার জিতবে বলে আশার কথা তো আগেই বললেন। তা শিরোপা ধরে রাখার পথে কোন দলকে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করছেন?

কারেম্বু: আমি তো আগেই বলে দিয়েছি, কাতারে ফাইনাল হবে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যে। মেসি বনাম এমবাপ্পে।

শুভ্র: এটা আপনার ভবিষ্যদ্বাণী নাকি আপনার চাওয়া?

কারেম্বু: না না, এটাই হবে। আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স (হাসি)।