এখন পর্যন্ত খুব কম লোকই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ফাইনালে আমি কোন দলকে এগিয়ে রাখছি। জার্মানি, না আর্জেন্টিনা?
উল্টো সবার একটাই প্রশ্ন, ব্রাজিলকে ওদের মাঠে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে কীভাবে ৭-১ গোলে হারানো সম্ভব? জার্মানরা কীভাবে এই অলৌকিক কাজটা করল? ৭-১ ব্যবধান ব্রাজিলে যেন কালো ছায়া হয়ে নেমে এসেছে, সেখানকার জীবনযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে। ওরা খেলা উপভোগ করতে ভুলে গেছে। আসলেই এখন আর অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। এই ধাক্কা সামলে উঠতে ব্রাজিলিয়ানদের যে কত দিন লাগে!
সেমিফাইনালের আগেই আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম, চোটের কারণে নেইমার আর দুই হলুদ কার্ডের নিষেধাজ্ঞায় থিয়াগো সিলভার না থাকার চড়া মূল্য দিতে হবে ব্রাজিলকে। যদিও ব্রাজিল আরও আঁটসাঁট হয়ে নামার পরিকল্পনা করে রেখেছিল। আমি কিন্তু নিশ্চিতই ছিলাম ব্রাজিল ভুগবে। কারণ জার্মানির মুখোমুখি হওয়ার আগে ওরা যে পাঁচটা ম্যাচ খেলেছে, কোনোটিতেই খুব ভালো কিছু দেখাতে পারেনি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেই শুরুর ম্যাচেই ওদের নানা সমস্যা ধরা পড়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, একক নৈপুণ্যনির্ভর দলটা প্রত্যাশার বিশাল ভার নিতে পারেনি। দরকারের সময় সেরা খেলাটাই খেলতে পারেনি ওরা।
জাতীয় সংগীতের সময়েই আমি ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের চোখেমুখে ভয়টা দেখতে পাচ্ছিলাম। ওরা এত আবেগের সঙ্গে, এত চিৎকার করে সেটা গাইছিল যে, দেখে মনে হয়েছে জোর করে নিজেদের সাহস দিতে চাইছে। ওরা নিজেরাই নিজেদের কত চাপে ফেলে দিয়েছিল সেটা বোঝা গেছে যখন হুলিও সিজার আর ডেভিড লুইজ নেইমারের জার্সিটা জড়িয়ে ধরে জাতীয় সংগীত গাইল। যেভাবে ২০ কোটি মানুষ, হাজার হাজার সমর্থক বিশ্বকাপ চাইছিল ওদের কাছে, তারপর আর এই বাড়তি চাপ না নিলেও হতো।
এই ভয় নিয়েই ব্রাজিলিয়ানরা খেলল। ওদের আত্মবিশ্বাস বলতে কিছু ছিল না। প্রতিপক্ষকে ওরা অতিরিক্ত সমীহ করা শুরু করেছিল। ফলে যেটা হয়েছে, নিজেদের রক্ষণভাগে প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি খেলোয়াড় থাকা অবস্থায়ও ওরা গোল খেয়ে গেছে। আর ৫-০ হয়ে যাওয়ার পর তো অবস্থা আরও খারাপ হলো। জার্মানরা বল নিয়ে মাঠের যেখানে ইচ্ছা যাচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছা খেলছে। ব্রাজিলের পুরো সিস্টেমটাই যেন জার্মানির সামনে এসে ধসে পড়ল।
জার্মানরা খুবই গতিময় ফুটবল খেলেছে। মাঠে ওদের দেখে অনেক সংঘবদ্ধ মনে হয়েছে। সবাই ওঠা–নামা করে খেলছিল। প্রত্যেকেই তার সতীর্থর জন্য খেলেছে। জার্মানির আগের ম্যাচগুলোতেও সবাই সেটা দেখেছে। ওদের তো আর মেসি বা নেইমার নেই। জোয়াকিম লো তাই তাঁর ছাত্রদের একটা দল হিসেবে খেলিয়েছেন। এমন একটা দল, যার ছয় খেলোয়াড় বুন্দেসলিগা চ্যাম্পিয়ন বায়ার্নের। এমন একটা দল, যাদের ম্যানুয়েল নয়্যারের মতো একজন গোলরক্ষক আছে। বিশ্বসেরা গোলরক্ষক।
এটা ঠিক, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালেও জার্মানি এভাবে খেলতে পারবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এটা তো সত্য, ৭-১ গোলে ব্রাজিলকে হারানোর পর এখন যেকোনো টুর্নামেন্টে, যেকোনো প্রতিপক্ষ জার্মানিকে সমীহ করবে।
রোববার মারাকানায় জার্মানি কিছুটা ঘরের মাঠের আবহ পাবে। স্বাগতিকদের সমর্থন পাবে। এটা শুধু এ কারণে নয় যে প্রতিবেশী চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে ব্রাজিলিয়ানরা খুব একটা পছন্দ করে না। এর কারণ জার্মান খেলোয়াড়দের ঔদার্য। যেভাবে সেমিফাইনালের পর জার্মান খেলোয়াড়েরা দুঃখী ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের সহমর্মিতা জানিয়েছে, আমার মনে হয় ব্রাজিলিয়ানরা সেটা মনে রাখবে। এটাই তো খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব। ফুটবলের মতো চমৎকার খেলায় এটাই দরকার। ভালো দলের এটাই বড় গুণ।
তার পরও আমি মনে করি আর্জেন্টাইনরা বিপজ্জনক হতে পারে। ডাচদের দেখুন না। আরিয়েন রোবেন আর ফন পার্সির নৈপুণ্যে দল হিসেবেই ডাচরা মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল। কিন্তু সেমিফাইনালে সেই ডাচরাই হাঁসফাঁস করেছে আর্জেন্টিনার দুর্ভেদ্য রক্ষণের সামনে গিয়ে। এই রক্ষণ ভেদ করা জার্মানির জন্যও বিশাল চ্যালেঞ্জ। আর সবচেয়ে বড় কথা সুপারস্টার মেসি তো আছেই। আপনি যদি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, এক মুহূর্তের জাদুতে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেবে। এ ছাড়া ডাচদের বিপক্ষে পেনাল্টি শুটআউটে দুটি শট ঠেকিয়ে দেওয়া আর্জেন্টাইনদের নায়ক সার্জিও রোমেরো আছে। আর্জেন্টিনাও দেখিয়েছে, বড় ম্যাচে তারা স্নায়ু কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
তবে আমার মনে হয়, ফাইনালে খুব বেশি গোলের আশা না করাই ভালো। যদি না জার্মানরা আরও একবার অমন অলৌকিক ম্যাচ উপহার দেয়।
শেষ পর্যন্ত যে দলই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হোক, মানুষের হৃদয়ের চ্যাম্পিয়ন কিন্তু এরই মধ্যে হয়ে গেছে জার্মানরা।