পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে সরু রাস্তাটা চলে গেছে সোজা। একটু সামনে এগোলেই বেগমবাজার গলি। এই গলির প্রতিটি বাড়ির নিচের অংশই গোলাপি রঙে রাঙানো।
গলির মাথায় ৮ নম্বর নাবালক মিয়া লেনের বাড়িতে পা দিলেই খেলার একটা আবহ টের পাওয়া যায়। জরাজীর্ণ দোতলা বাড়িটির নিচতলার দেয়ালে টাঙানো হকির কত না স্মারক! বাংলাদেশের হকির তৃণমূলের অতিপরিচিত কোচ ফজলুল ইসলামের এই বাড়ির কোথাও সাজানো আছে হকির পুরোনো কোনো স্মারক, কোথাও ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো সনদ, কোথাও-বা পড়ে আছে হকিস্টিক-বল-জুতা। আর একবার বাড়ির ছাদে উঠে যেতে পারলে তো বিস্ময়ের শেষ থাকবে না।
না, নাবালক মিয়া লেনের এই বাড়ির ছাদে সবুজে ঘেরা কোনো ছাদবাগান নেই। হালে ছাদ মানেই যদিও ছাদবাগান, তবে ফজলুল ইসলামের নীলচে রং করা ছাদটি মন কাড়ে ছাদ-হকির জন্য। হ্যাঁ, ছাদে ছোটখাটো একটা ‘হকি মাঠ’ই বানিয়ে ফেলেছেন তিনি! হকির প্রতি একজন মানুষের ভালোবাসা কতটা গভীর হলে এটা সম্ভব!
হকি খেলাটা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যেরই অংশ। ‘ফজলু ওস্তাদ’ নামে পরিচিত হকি কোচ ফজলুল ইসলামের কোচিং কার্যক্রম চলত মূলত বাংলাদেশের হকির সূতিকাগার আরমানিটোলা স্কুল মাঠে। এলাকার ছেলেদের সেখানেই অনুশীলন করাতেন তিনি। করোনাকালে মাঠ ছেড়ে কিশোর-তরুণেরা যখন ঘরে ঢুকে গেল, ফজলু ওস্তাদ ভাবলেন, বিকল্প কিছু করা দরকার। সে চিন্তা থেকেই নিজের বাড়ির ছাদে হকি অনুশীলনের ব্যবস্থা। এলাকার ছোট ছোট ছেলেকে সেখানে যত্নের সঙ্গে অনুশীলন করান ফজলু ওস্তাদ। করোনার মধ্যেও চালু রেখেছেন ভবিষ্যতের হকি খেলোয়াড় তৈরির কাজ।
গত মঙ্গলবার বিকেলে ছাত্রদের হকির কলাকৌশল শেখানোর এক ফাঁকে ছাদের হকি ‘মাঠে’ দাঁড়িয়ে ফজলু এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে যাওয়া মানুষ আমি। ছেলেদের নিয়ে অনুশীলনে নেমে পড়ি। কিন্তু করোনার শুরুতে বাসায় বসে থাকতে থাকতে আর সময় কাটছিল না, ছেলেদের অনুশীলনও বন্ধ হয়ে গেল। সব মিলিয়ে রীতিমতো দমবন্ধ লাগছিল আমার। হঠাৎ মাথায় এল, আমি তো বাসার ছাদেই কিছু করতে পারি!’
সেই ভাবনা থেকেই বাড়ির ছাদ পরিষ্কার করে সেখানে হকি মাঠের আবহ তৈরি করেছেন ফজলু ওস্তাদ। প্রথমে বিকেলবেলায় পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনুশীলন শুরু করেন। এরপর এলাকার ছোট ছোট ছেলেকে নিয়ে এসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামিয়ে দেন হকির অনুশীলনে। ফজলু ওস্তাদের হকির পাঠশালা দেখে আস্তে আস্তে আগ্রহ বাড়তে থাকে অন্যদেরও।
হকি মাঠের আবহ আনতে ২৪ ফুট লম্বা ও ১৪ ফুট চওড়া ছাদের মেঝেটাকে ফজলু ওস্তাদ নীল রঙে রাঙিয়ে নিয়েছেন। দেয়ালের গায়ে রং দিয়ে এঁকে নিয়েছেন গোলবার। বাচ্চাদের যেন মনে হয় তারা হকি মাঠেই অনুশীলন করছে। এসব দেখাতে দেখাতে ফজলু বলছিলেন, ‘গোলপোস্টটা এমনভাবে আঁকলাম যাতে বাচ্চারা মনে করে এটা স্টেডিয়ামের সত্যিকারের পোস্ট। এখানে অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে পারায় খুব ভালো লাগে আমার। বাচ্চাদের তো উন্নতি হচ্ছে। এখানে খেলেও ওরা একদিন জাতীয় দলে খেলবে, এটাই আমার স্বপ্ন।’
ফজলু ওস্তাদের ছাদ-হকির খুদে খেলোয়াড়দের মধ্যে মেয়েও আছে একজন। সব মিলিয়ে সাত-আটজনের দলটা প্রতিদিনই অনুশীলন করে। আর কিছু না হোক, করোনার মধ্যে ঘরে বসে থাকার চেয়ে ছাদে স্টিক-বল নিয়ে পড়ে থাকাটা তো ভালো! বাচ্চাদের কাছেও এটাই অনেক আনন্দের।
এই বয়সে ওদের স্টিক ওয়ার্কও মন কাড়বে যে কারও। সাত বছরের ওয়াসিম আকবর স্টিকের কারুকাজ দেখাতে দেখাতে বলল তার স্বপ্নের কথা, ‘আমি কামাল ভাই আর জিমি মামার মতো হতে চাই।’ রফিকুল ইসলাম কামাল ও রাসেল মাহমুদ জিমি পুরান ঢাকা থেকেই উঠে আসা বাংলাদেশের হকির দুই প্রজন্মের দুই উজ্জ্বল মুখ। আরও অগুনতি খেলোয়াড়ের মতো এই দুই তারকা খেলোয়াড়ও কোচ ফজলু ওস্তাদের হাতে গড়া। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তিনি খেলোয়াড় তৈরি করে চলেছেন ‘কী পেলাম’ সে হিসাব না করেই।
কে জানে, ফজলু ওস্তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় একদিন হয়তো তাঁর ছাদ-হকি থেকেই উঠে আসবে আগামী দিনের কোনো তারকা!