একের পর এক গোলই শুধু করে গেছেন পেলে। প্রতিপক্ষের জালে কতবার বল জড়ালেন, সেই খেয়ালও হয়তো রাখেননি। কিন্তু তাঁর এই গোলের হিসাব রাখতে গিয়েই পরবর্তী সময়ে হিমশিম খেতে হয়েছে পরিসংখ্যানবিদদের। পেলেই সর্বকালের সেরা ফুটবলার কি না, এ নিয়ে যেমন বহু বিতর্ক হয়েছে, তেমনি পেলের গোলসংখ্যা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ২১ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ঠিক কতগুলো গোল করেছিলেন, সেটার হিসাব রাখা সত্যিই সহজ ছিল না। আর কঠিন এ কাজটাই করতে হয়েছে রোজারিও লোপেজ জিলিকে।
সান্তোসে পেলের শেষ দুই বছরের খেলা দেখেছিলেন জিলি। প্রিয় খেলোয়াড়ের প্রতিটি গোল দেখে ফেটে পড়তেন উল্লাসে। তখন হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, এসব গোলের হিসাব রাখার ভার এক সময় তাঁর কাঁধেই বর্তাবে। বিস্তর গবেষণা করে পেলের গোলসংখ্যা নির্ধারণের সে কাজটাই জিলি করে যাচ্ছেন ২০১১ সাল থেকে। প্রস্তাবটা পেয়েছিলেন খোদ পেলের কাছ থেকেই। এ বছর বিশ্বকাপের সময়ই ব্রাজিলে উন্মোচন করা হবে পেলের ব্যক্তিগত জাদুঘর। সেটাকে সামনে রেখেই পেলের প্রতিটি গোলের হিসাব হাজির করছেন জিলি।
এখন ফুটবলের সবকিছুর পুঙ্খানুপঙ্খ হিসাব রাখা সম্ভব। কার পায়ে কতক্ষণ বল ছিল, কে কাকে কয়টি পাস দিয়েছেন—সবকিছু জানা যায় কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে! কিন্তু একসময় শুধু গোলের হিসাব রাখাই ছিল অনেক ঝক্কির ব্যাপার। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার হিসাব অনুসারে, পেলের গোলসংখ্যা ১২৮১। উইকিপিডিয়াও পেলের নামের পাশে লিখেছে ১২৮১ সংখ্যাটিই। কেউ কেউ আবার বলেন ২১ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ১২৮৩টি গোল করেছিলেন পেলে। জিলি অবশ্য একমত হতে পারেননি কারও সঙ্গেই। তাঁর হিসাব অনুযায়ী, পেলের গোলসংখ্যা ১২৮২। কিন্তু এটাও কী সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে? জিলি নিজেও তেমন নিশ্চয়তা দিতে পারেননি, ‘আমি সত্যিই এই নিশ্চয়তা দিতে পারি না। ব্যাপারটা আশা করাও ভুল যে আমি একটা হিসাব দেব আর অন্য সকলে সেটা একবাক্যে মেনে নেবে।’
১৯৬০ সালের একটা ম্যাচ নিয়েই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। পোল্যান্ডের বিপক্ষে একটা প্রীতিম্যাচ খেলতে গিয়েছিল সান্তোস। সেই ম্যাচে পেলের দল জিতেছিল ৫-০ গোলে। সবাই বলে, পাঁচটি গোলই নাকি করেছিলেন পেলে। কিন্তু ম্যাচের শেষ গোলটা পেলে করেছিলেন, নাকি তাঁরই দীর্ঘদিনের সতীর্থ কুটিনহো করেছিলেন; তা নিয়ে সংশয় কাটেনি কোনোদিনই। সেই ম্যাচের একটা ছবি দেখে মনে হয় বলটা জালে ঠেলেছিলেন কুটিনহোই। কিন্তু সবাই বলে গোলটা পেলেই করেছিলেন। এই বিতর্ক কোনোদিন শেষ হবে বলে মনে করেন না পেলের গোলগণক জিলি। তিনি নিজেও যে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি, ‘কেউই এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারবে না। আমি নিজেও ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিত নই।’
জিলি নিশ্চিত নন পেলের জাদুঘর নিয়েও, ‘ওই জাদুঘর নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই জাদুঘরটা উদ্বোধন করার পরে সবাই আমার গবেষণাকেই নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে মেনে নেবে কিনা। কেউ যদি সংখ্যাটা ১২৮১ বা ১২৮৩ বলে, তাহলে তারাও সঠিক। আসলে এই বিতর্কটাই সবকিছুর প্রাণ।’
কেবল পেলের গোলসংখ্যা নয়। বিতর্ক চলছে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারের পাশে দাঁড়ানোর স্থানটি নিয়েও। পেলের সঙ্গে ভবিষ্যতে দাঁড়াবেন কে? জিলি মনে-প্রাণেই বিশ্বাস করেন পেলের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা এই প্রজন্মে কেবল লিওনেল মেসিরই রয়েছে, ‘আমি বিশ্বাস করি মেসি একদিন পেলের রেকর্ড ভেঙে ফেলবেই। রোমারিও খুব কাছাকাছি গিয়েছিল। কিন্তু সে পারেনি।’
মেসিকে পেলের যোগ্য উত্তরসূরি বললেও একটা জায়গায় পেলে কিন্তু এগিয়ে আছেন মেসির চেয়ে যোজন ব্যবধানে। সেটা কী শুনুন জিলির বয়ানেই, ‘সবাই এক বছরে মেসির ৯১ গোলের গল্প করে। কিন্তু পেলে ১৯৫৯ সালে যা করেছিলেন তার কাছে এটি কিছুই না। সে বছর তিনি করেছিলেন ১২৫ গোল। আমার মনে হয় না কেউ এই রেকর্ড ভাঙতে পারবে।’
গোলগণনার কাজ শেষ করেই হাত গুটিয়ে ফেলেননি জিলি। পেলের বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারকে আরও মূর্ত করে তোলার কাজটা তিনি করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। পেলে ফুটবলের কারণে বিশ্বের কোথায় কোথায় পা রেখেছেন, সেটারও পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখছেন জিলি। সংগ্রহ করে যাচ্ছেন পেলের সে সময়ের ভিসা-পাসপোর্টগুলোও।