>করোনার দিনে এত আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবরে মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর চেয়ে কিছু অনুপ্রেরণার গল্প শুনলে কেমন হয়? আঘাত, চোট, বদভ্যাস থেকে ফিরে আসার গল্প তো অনেকই আছে খেলার জগতে। তাঁর তৃতীয় পর্বে আজ মেয়েদের টেনিসের কিংবদন্তি মনিকা সেলেস ও বার্সেলোনার সাবেক ডিফেন্ডার এরিক আবিদালের গল্প -
এমন ভক্ত কারো না জুটুক
সেরেনা উইলিয়ামস সেই ২০১৭ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতার পর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু মার্গারেট কোর্টের ২৪ গ্র্যান্ড স্লামের রেকর্ড আর ছোঁয়া হচ্ছে না। ২২ গ্র্যান্ড স্লাম নিয়ে স্টেফি গ্রাফ আছেন তালিকার তিনে। মেয়েদের টেনিসের এককে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লামের সেই তালিকায় মনিকা সেলেসের নাম খুঁজতে অনেক পেছনে যেতে হয়। সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় জন্ম নেওয়া ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেওয়া টেনিস কিংবদন্তির গ্র্যান্ড স্লাম যে মাত্র ৯টি।
অথচ ১৯৯৩ সালের ৩০ এপ্রিল ওভাবে ছুরিকাহত না হলে হয়তো মেয়েদের টেনিসের সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম থাকত তাঁর নামের পাশেই! মেয়েদের টেনিসের আরেক কিংবদন্তি মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে সোজাসুজিই বলে দিয়েছিলেন, ছুরিকাহত না হলে 'মার্গারেট কোর্ট বা স্টেফি গ্রাফকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্লাম হতো মনিকারই।''
টেনিসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেলেসের শুরুতে যে ইঙ্গিতটা তেমন কিছুরই ছিল! বয়স তখনো ২০-ও হয়নি, ততদিনেই ৮টি গ্র্যান্ডস্লাম জেতা সারা! ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেশাদার টেনিস নাম লিখিয়েছেন। সেবারের ফ্রেঞ্চ ওপেন ছিল তাঁর প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম, তাতেই সেমিফাইনালে সেলেস। ১৯৯০ ফ্রেঞ্চ ওপেন দিয়ে গ্র্যান্ড স্লামের শিরোপামঞ্চে আলো ছড়ানোর শুরু। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর ৬ মাস, এর চেয়ে কম বয়সে ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতার রেকর্ড আজও নেই।
এরপর? শুধু উইম্বলডনেই পারেননি, এর বাইরে বাকি তিন গ্র্যান্ড স্লামেই সেলেস-ত্রাস! ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতলেন টানা তিনবার, ১৯৯১ থেকে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও টানা তিনটি, ১৯৯১ ও ১৯৯২-তে টানা দুই ইউএস ওপেন! উইম্বলডনে শুধু ১৯৯২ সালে ফাইনালে ওঠাই তাঁর সর্বোচ্চ সাফল্য। এতেও তাঁর দাপট স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না? সে ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান বলবে, ১৯৯১ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ২২টি শিরোপা জিতেছিলেন সেলেস। এ সময়ে ৩৪টি টুর্নামেন্ট অংশ নিয়েছেন, তার ৩৩টিতেই খেলেছেন ফাইনাল! এ সময়ে সব মিলিয়ে ১৫৯ জয়ের বিপরীতে তাঁর হার ছিল ১২টি (৯২.৯ শতাংশ জয়ের হার)। আর গ্র্যান্ড স্লামে রেকর্ডটা? ৫৫ জয়ের বিপরীতে একটি হার ১৯৯২ উইম্বলডনের ফাইনালে, জার্মান কিংবদন্তি স্টেফি গ্রাফের কাছে।
আর কাকে হারিয়েছেন, তার হিসেব করার বদলে কাকে হারাননি সেই হিসেব করাই বোধ হয় সহজ। গ্রাফ, মার্টিনা হিঙ্গিস, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, জাস্টিন হেনিন, ভেনাস উইলিয়ামস, মারিয়া শারাপোভা, কিম ক্লাইস্টার্স, লিন্ডসে ডেভেনপোর্ট...সেলেসের কাছে হারের স্বাদ পেয়েছেন সবাই-ই। যাঁর কাছ থেকে ১৯৯১ সালের মার্চে র্যাঙ্কিং শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট কেড়ে নিয়ে আর হাতছাড়া করেননি পরের দুই বছর, সেই স্টেফি গ্রাফের বিপক্ষে চারটি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালের তিনটিতেই জিতেছিলেন।
সেটিই বুঝি খেপিয়ে দিয়েছিল নিজেকে গ্রাফের ভক্ত দাবি করা গুন্টার পার্শকে! গ্রাফ নিজেও হয়তো কখনো কল্পনা করেননি, এমন মস্তিষ্কবিকৃত ভক্ত তাঁর হতে পারে! যে ভক্ত সেলেসের জন্য এসেছিলেন দুঃস্বপ্ন হয়ে।
দুঃস্বপ্নের সেই দিনটা ১৯৯৩ সালের ৩০ এপ্রিল। হামবুর্গ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে মাগদেলানা মালিভার বিপক্ষে তখন এগিয়ে সেলেস। ম্যাচের তখন বিরতি চলছিল। সেলেস নিজের চেয়ারে বসা। হঠাৎ দর্শকসারি থেকে দৌড়ে কোর্টে নেমে পড়েন পার্শ নামের ওই স্টেফিভক্ত। হাতে ছুরি! এসেই সেলেসের কাঁধে ছুরির কোপ বসিয়ে দিলেন! ১.৫ সেন্টিমিটার গভীর সেই ক্ষত! সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সেলেসকে। শারীরিক আঘাতটা কাটিয়ে উঠতে তো খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। লাগেওনি। কয়েক সপ্তাহেই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শরীরের ক্ষতটা সারলেও মনের ক্ষত হয়ে থেকে যায় দুঃস্বপ্নটা।
সেলেস যুগোস্লাভিয়ার বলে সেলেসের ওপর ওই আঘাতকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও তখন দেখা হয়েছিল। যুগোস্লাভ যুদ্ধের কারণে এর আগে মৃত্যুহুমকিও পেয়েছিলেন বেশ কবার। কিন্তু জার্মান কর্তৃপক্ষ সে অভিযোগ অস্বীকার করে দ্রুতই। পরে জানা যায়, হামলাকারী পার্শ মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। সাজাটাও নামমাত্রই হয় পার্শের। সেটি কখনো মানতে পারেননি সেলেস, এরপর আর জার্মানিতেও কখনো খেলেননি। সেলেস যখন হাসপাতালে ছিলেন, স্টেফি গ্রাফ অবশ্য তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। হয়তো তাঁরই অপ্রকৃতিস্থ ভক্ত এমন কান্ড ঘটিয়েছে, এ নিয়ে অন্তর্যাতনা ছিল স্টেফির। এমন ভক্ত যে কেউ চায় না!
দুঃস্বপ্নকে পেছনে রেখে ১৯৯৫ সালের আগস্টে ফেরেন সেলেস। ফেরার পর ১৯৯৬ ফ্রেঞ্চ ওপেনও জিতেছেন। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেওয়া সেলেস যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯৯৬, ১৯৯৯ ও ২০০০ ফেড কাপও এনে দিয়েছেন। তা দিয়েছেন বটে, তবে আগের সেই দাপুটে ধারাবাহিক রূপ আর কখনো ফিরে পাননি।
অস্ত্রোপচার টেবিল থেকে ইউরোপসেরার মঞ্চে
পেপ গার্দিওলার অধীন বার্সেলোনার সর্বজয়ী দলটাতে তাঁর নাম হয়তো অতটা সমস্বরে উচ্চারিত হয় না। তা-ই স্বাভাবিক। মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, এমনকি পিকে-পুয়োল বা দানি আলভেজরা যতটা আলো কেড়ে নিতে পেরেছেন, এরিক আবিদাল ততটা আর পেরেছেন কই? কিন্তু বার্সেলোনার কোনো খেলোয়াড়ের পাশে দাঁড়াতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর স্কোরবোর্ডে বিশেষ বার্তা ভেসেছে, রিয়ালের খেলোয়াড়েরা বিশেষ জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন তাঁর নাম লেখা, এমনটা আবিদাল ছাড়া আর কোন বার্সা ফুটবলারের বেলায় হয়েছে?
ফরাসি ডিফেন্ডারের অসুস্থ হওয়া আর সেটি থেকে ফিরে আসার গল্পটাও তো তেমনই অনুপ্রেরণার। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ দিনটা বার্সেলোনা ভক্তদের জন্য বেশ উদ্বেগ নিয়েই এসেছিল। কাতালান ক্লাবটির ঘোষণা, আবিদালের লিভারে টিউমার ধরা পড়েছে। দুদিন পরই অস্ত্রোপচারের টেবিলে আবিদাল। তাঁর অনুরোধেই গোপনীয়তা বজায় রেখে তাঁর শারীরিক অবস্থার আর বিশদ খোলাসা করেনি বার্সেলোনা।
না করুক, কিন্তু একজন সহ-খেলোয়াড়ের এমন অসুস্থতার খবর নাড়া দিয়ে গেছে ফুটবলকেই। খবরটা আসার কয়েকদিন পর আবিদালের সাবেক ক্লাব অলিম্পিক লিওঁর বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর ম্যাচে রিয়াল-লিওঁ দুদলের খেলোয়াড়েরাই বিশেষ টি-শার্ট পরে নেমেছিলেন ম্যাচের আগে, যাতে লেখা ছিল–আনিমো আবিদাল। বাংলায়, সুস্থ হয়ে ওঠো আবিদাল। একই বার্তা ছিল সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর স্কোরবোর্ডেও।
আর বার্সেলোনা? আনিমো আবিদাল লেখা টি-শার্ট তো ছিলই, ১৯ মার্চ গেতাফের বিপক্ষে লিগে বার্সার ম্যাচে পুরো স্টেডিয়ামের সমর্থকেরা ম্যাচের ২২ মিনিটে পুরো মিনিটজুড়ে হাততালি দিয়েছিলেন। বার্সায় আবিদালের জার্সি নম্বর যে ২২!
এই করতালি, টি-শার্টের বার্তা এসব হয়তো মানসিকভাবে কিছুটা অনুপ্রেরণা দিয়েছে আবিদালকে। ফিরে আসতে বেশি সময় নেননি ফরাসি লেফটব্যাক! এত দ্রুতই ফিরেছিলেন যে, ১১ মে ওয়েম্বলিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পুরো ৯০ মিনিটই খেলেছিলেন। ৩-১ গোলে জিতে তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা সেবার ঘরে তুলেছিল বার্সেলোনা। ম্যাচটাতে আবিদালকে বিশেষ সম্মানও দিয়েছে বার্সা। নিয়মিত অধিনায়ক কার্লোস পুয়োল নিজের বাহুবন্ধনী খুলে পরিয়ে দেন আবিদালের বাহুতে। ওয়েম্বলির শিরোপামঞ্চে ৮৫ হাজার দর্শকের সামনে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরেন আবিদালই।
তবে সেটি ছিল তাঁর প্রথম দফায় ফেরা। ২০১২ সালের ১৫ মার্চ আবার বার্সা জানায়, আগের অস্ত্রোপচারের পরও কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছিল আবিদালের। সেটা সারাতে এবার তাঁর লিভার ট্রান্সপ্লান্টই করা লাগবে। ১০ এপ্রিল হয় ট্রান্সপ্লান্ট, লিভার দান করেন আবিদালের কাজিন জেরার্ড। পরে আবিদাল জানান, বার্সায় তাঁর সতীর্থ ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাক দানি আলভেজ তাঁকে লিভার দান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে আলভেজের ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে ভেবে আবিদাল তাতে রাজি হননি।
দ্বিতীয় দফায় ফিরতে অবশ্য আগের চেয়ে একটু বেশি সময় লেগেছে আবিদালের। লাগারই কথা। ২১ মে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া আবিদাল অনুশীলনে ফেরেন ডিসেম্বরে। মাঠে ফেরেন পরের বছরের জানুয়ারিতে।
বার্সেলোনার হয়ে এরপর আর বেশি খেলা হয়নি। ২০১৩ সালের জুনেই ক্লাব ছেড়ে যান। পরে মোনাকো আর গ্রিসের অলিম্পিয়াকোসে খেলেছেন বটে, তাতে শিরোপা বলতে অলিম্পিয়াকোসের হয়ে জিতেছেন গ্রিক লিগ।