সাদাসিধে একটা ছবি। ছবির কুশীলব দুজন। একজনের বাহুডোরে বাঁধা পড়েছেন আরেকজন। দুজনের হু হু কান্না যেন অনুচ্চারে জানিয়ে দিচ্ছে স্বজন হারানোর বেদনা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, এমন ছবি তো হরহামেশাই দেখা যায়। প্রিয়জনের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান মানুষের চিত্র তো এমনই হয়। হৃদয়ছোঁয়া, কিন্তু বিরল নয়।
তবে এই ছবিটা নিঃসন্দেহে বিরল। বিরল করে দিচ্ছে ছবির দুই কুশীলবের পোশাক। দুজনের একজনের গায়ে লাল-সাদা জার্সি। তাঁকে পরম মমতায় যিনি বুকে টেনে নিয়েছেন, তাঁর জার্সির রং নীল-হলুদ। ফুটবলের খোঁজখবর যাঁরা একটু হলেও রাখেন, তাঁদের বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা না জার্সিটা কোন দুই দলের। এক দল বুয়েনস এইরেসের কুলীনকুলের প্রতিভূ, আরেক দল গায় খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের গান। এমন দুই দল, যাদের খেলা হলে ফুটবল-উন্মাদ আর্জেন্টিনা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থেই। পানশালা, দোকানপাট, অফিসে মানুষের তর্ক–বিতর্কের মাত্রাটা হাতাহাতি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে প্রতিনিয়ত। কয়েক বছর আগে শোনা গিয়েছিল, দুই দলের দুই সমর্থক জনৈক শ্যালক-দুলাভাইয়ের তর্কের মাত্রাটা এতই বেড়ে গিয়েছিল, দুলাভাই রেগেমেগে শ্যালকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মারামারি করে হাসপাতালে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে হরহামেশা। এ তো গেল স্টেডিয়ামের বাইরের খবর। স্টেডিয়ামের ভেতরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। অনেক সময় এমনও হয়, দুই দলের সমর্থকদের মারামারি-রেষারেষির জের ধরে খেলাই হয় না। সমর্থকদের দ্বন্দ্বের উত্তাপ মাঠের ভেতরে থাকা খেলোয়াড়দের গায়েও লাগে, রক্তে জাগে নাচন। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ মন্ত্রে দীক্ষিত দুই দলের খেলোয়াড়দের মারামারি হয়েছে, এমন খবর না শোনাটাই বরং আশ্চর্যের।
বলা হচ্ছিল বোকা জুনিয়র্স আর রিভার প্লেটের কথা। বোকা জুনিয়র্সের জার্সি নীল-হলুদ, রিভারের লাল-সাদা। স্বজন হারানোর বেদনায় লীন রিভার প্লেটের সমর্থক কেঁদেকেটে দুদণ্ড স্বস্তির খোঁজে ঠাঁই নিয়েছেন ‘চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী’ বোকা জুনিয়র্সের এক সমর্থকের বুকে।
স্বজন। হ্যাঁ, স্বজনই বটে। ডিয়েগো ম্যারাডোনা আর্জেন্টাইনদের কাছে স্বজন তো অবশ্যই। তর্কযোগ্যভাবে তিনি দেশটার একমাত্র মানুষ, যিনি বোকা-রিভারকে এক সুতায় গাঁথতে পারেন। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি বোকার কিংবদন্তি হওয়া সত্ত্বেও রিভার সমর্থকদের মনের মণিকোঠায় আবাস করতে পারেন স্বাচ্ছন্দ্যে। দেশের ইতিহাসের বিশ্বকাপজয়ী সবচেয়ে সফল খেলোয়াড়ের প্রতি সমর্থকদের ব্যবহার তো এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা–ই না?
এমন কিংবদন্তির মৃত্যুতে শত্রুতার, বিভেদের সব সীমারেখা অদৃশ্য হয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যখন শত্রুতা, বৈরিতা, দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো প্রচণ্ড রকমের খেলো বলে মনে হয়। মনে হয়, দিন শেষে সবাই-ই তো রক্ত–মাংসের মানুষ। মনে হয়, যা-ই করি না কেন, দিন শেষে সবাইকেই তো ওই এক অচিনের পানে ছুটতে হবে, তা–ই না? কী দরকার একটা চর্মগোলকের খেলায় কে জিতল না জিতল সেটা নিয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে? নিখাদ বিনোদনের এক মাধ্যমের জন্য নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করার কী মানে? ডিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুটা যেন ঠিক অমন।
তাঁর মৃত্যুটা এতই মহান, বোকা-রিভারকেও যা নিয়ে আসে একই কাতারে। অনেক সময় একটা আলোকচিত্র বলে হাজার শব্দের চেয়েও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কথাটা যিনি বলেছেন, এমন কোনো ছবির কথা মাথায় নিয়েই বলেছিলেন হয়তো!