শেষ বাঁশি বাজার পর গ্যালারির সমর্থকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গাইলেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরা। মাঠে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর জার্সি ঘোরাতে ঘোরাতে। একটু আগে শেষ হওয়া ম্যাচটার চেয়ে ওই দৃশ্যটাই বরং বেশি উপভোগ্য হলো। ম্যাচটা যে আর্জেন্টিনার জয় ভিন্ন অন্য কোনো তাৎপর্যই বহন করল না।
আর্জেন্টিনা লাতিন আমেরিকান ফুটবলের উজ্জ্বল প্রতিনিধি হতে পারে, বেলজিয়াম অবশ্যই ইউরোপীয় ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন নয়। তার পরও এই ম্যাচটিকে দুটি ভিন্ন ঘরানার লড়াই বলে জমজমাট একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশা তো ছিলই। সেই আশার গুড়ে কিচকিচে বালু ছিটিয়ে দেওয়ার কাজটা অবশ্য দুদল মিলেই করল।
পার্থক্য হলো, বেলজিয়ামের কিছু করারই ক্ষমতা ছিল না। আর আর্জেন্টিনা পারলেও যেন ইচ্ছা করেই শক্তি ক্ষয় করল না। দুটি মিলিয়ে যা হয়, তা আর যা-ই হোক, স্মরণীয় কোনো ম্যাচের রেসিপি নয়।
আগের দিন একই সময়ে শুরু মারাকানায় জার্মানি-ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনালের সঙ্গে চাইলে মিল খোঁজাই যায়। শুরুতেই জার্মানি গোল করে ফেলার পর হাই তোলা ফুটবল। মারাকানায় তাও ফ্রান্স বেশ কটি গোলের সুযোগ তৈরি করেছিল। এখানে বেলজিয়াম এমন কল্পনাশক্তিহীন জড়ভরত এক দল যে, ৮ মিনিটে গোল খেয়ে বসার পর একটা কাজই একঘেয়েভাবে করে গেল। বক্সে ক্রস ফেলার চেষ্টা করা। কিন্তু সেখানে বল যাওয়ার পর সেটি নিয়ে কী করতে হবে, তা নিয়ে মহা সংশয়ে পড়া।
বেলজিয়ামকে নিয়ে এবারের বিশ্বকাপ শুরুর আগে অনেক কথা হয়েছে। বাছাইপর্বে পারফরম্যান্স, তথাকথিত ‘সোনালি প্রজন্ম’ মিলিয়ে ‘কালো ঘোড়া’ তো বলা হয়েছেই; অনেকে আবার আরেকটু এগিয়ে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনাও দেখে ফেলেছিলেন। গ্রুপের তিনটি ম্যাচেই জয় পেলে কী হবে, এমন কিছু ভাবাটা যে বাড়াবাড়ি, সেটি ভালোমতোই বুঝিয়ে দিয়েছে বেলজিয়াম। সামনে থেকে বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা পালন করেছেন এডেন হ্যাজার্ড। এত হইচই তাঁকে নিয়ে, অথচ এমনই দুরবস্থা যে, কাল তাঁকে তুলে নিতে বাধ্য হলেন কোচ।
আর্জেন্টিনা কাল যে খেলাটা খেলল, সেটিকে বলে হিসেবি ফুটবল। ৮ মিনিটেই গোলটা পেয়ে যাওয়ার পর আর অযথা শক্তি খরচ করল না। খেলল অনেকটা হেলেদুলেই। এমনিতে এক গোলের ‘কুশন’ মোটেই ভরসা দেওয়ার মতো নয়। হঠাৎ একটা গোল হয়ে গেলেই তো সর্বনাশ। তার পরও দ্বিতীয় গোলের জন্য তেড়েফুঁড়ে চেষ্টা করতেই দেখা গেল না। এমনকি লিওনেল মেসিও এই বিশ্বকাপে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে কালই সবচেয়ে নিষ্প্রভ হয়ে রইলেন। ৯০ মিনিট মেসি মাঠে থাকলে দু-একবার তো কিছু না কিছু ঝলক দেখা যাবেই। তা সেটি দেখাও গেল। কিন্তু মেসির কাছ থেকে কি আর ওটুকু পেয়ে কেউ সন্তুষ্ট থাকে?
কাল অবশ্য আর্জেন্টিনা শিবিরে কেউই অসন্তুষ্ট নয়। দলের খেলোয়াড়েরা নন, কোচ আলেসান্দ্রো সাবেলা নন, সমর্থকেরাও নন। মানে গারিঞ্চা স্টেডিয়ামের মিডিয়া ট্রিবিউনে বসে যখন এই লেখা লিখছি, ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে আধা ঘণ্টারও বেশি আগে। গ্যালারির একটা অংশে এখনো নাচতে নাচতে গান গেয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টাইন-সমর্থকেরা।
যেটি আসলে এর আগে পরিচয় হয়নি, এমন এক আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। সেমিফাইনালে ওঠার আনন্দ। এই সমর্থকদের বেশির ভাগই যে তাঁদের জীবনে কখনো আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলতে দেখেননি! বিশ্বকাপে সর্বশেষ এই ঘটনা ১৯৯০ সালে। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা সেবার টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনাল খেলেছিল। এর পর পাঁচটি বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের বেশি আর এগোনো হয়নি। কখনো বা বিদায়ঘণ্টা বেজেছে এর আগেই।
অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, আর্জেন্টিনার খেলায় তাও একটা বাড়তি ছটা ছিল। ম্যাচের ৩৩ মিনিটে ডি মারিয়া হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে উঠে যাওয়ায় তাই আর্জেন্টিনার চেয়েও দর্শকদের ক্ষতি বেশি হলো। আর্জেন্টিনার গোলটিতেও ডি মারিয়ার পরোক্ষ অবদান আছে। সেটি অবশ্য বেশি পরোক্ষ। তাঁর পাস বেলজিয়ান এক খেলোয়াড়ের পায়ে লেগে বক্সে হিগুয়েইনের সামনে পড়ে। হিগুয়েইন চলতি বলেই শট নিয়ে গোল করে ফেলেন।
এভাবে বললে মনে হয় যেন হিগুয়েইন দুর্ঘটনাক্রমে গোল করে ফেলেছেন। আগের চার ম্যাচের পারফরম্যান্সে এমন মনে হতেই পারে। তবে কাল হিগুয়েইন পুরোনো ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে দারুণ খেলেছেন। গোলও তো আরেকটিও পেয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। পাল্টা আক্রমণ থেকে একা বল নিয়ে ঢুকে পড়ে শটটাও নিয়েছিলেন ভালো। কিন্তু সেটি কোর্তোয়াকে হারালেও ক্রসবারকে হারাতে পারেনি।
ও হ্যাঁ, কোর্তোয়ার গর্বের রেকর্ডটি কিন্তু অক্ষুণ্নই থাকল। গত মৌসুমে ছয় ম্যাচ খেলেও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বেলজিয়ান গোলরক্ষকের বিপক্ষে গোল করতে পারেননি মেসি। পারলেন না কালও। সেটি ম্যাচের শেষ দিকে মোক্ষম সুযোগ পেয়েও। ওয়ান টু ওয়ান পেয়ে গিয়েছিলেন কোর্তোয়াকে। তার পরও তাঁকে হারাতে পারেননি।
যুদ্ধের মধ্যে ছোট ছোট ওসব লড়াইয়ের ফল নিয়ে কে মাথা ঘামাতে যায়! অন্তত আর্জেন্টাইন-সমর্থকেরা তো অবশ্যই নয়। এই লেখা শেষ করে আনার সময় দেখছি, গ্যালারি থেকে আর্জেন্টাইনদের লাইন ধরে বের করে দিচ্ছে পুলিশ। নইলে ওই নাচ-গান যে আরও কতক্ষণ চলত, কে জানে!