ইডেনের হৃদয় ভেঙে দেওয়াটাকে যেন নিয়মই বানিয়ে ফেলেছে ওয়াংখেড়ে!
১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে কপিল দেবের ভারতের প্রতীক্ষায় ছিল ইডেন। ওয়াংখেড়েতে সেমিফাইনালে গ্রাহাম গুচের সুইপের বন্যায় ভেসে যায় ভারতের ফাইনালের স্বপ্ন। ইডেনেরও।
দুই বছর পর জওহরলাল নেহরুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত নেহরু কাপেও একই গল্প। তখন টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে এক নিউজিল্যান্ড ছাড়া সব দলই ছিল ওই টুর্নামেন্টে। প্রায় বিশ্বকাপই তো! এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সঙ্গে সেটি আরও মেলে। সেবারও ওয়াংখেড়ের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজই বিদায় করে দিয়েছিল ভারতকে।
আগের দুবারের মতো এবারও ফাইনালের ইডেন যেন ভাড়া দেওয়া কমিউনিটি সেন্টার। সেজেগুজে বিয়ের জন্য প্রস্তুত। শুধু বর-কনে কেউই নিজেদের নয়!
ইডেনে ভারতের বড় ফাইনাল বলতে ১৯৯৩ হিরো কাপ। তবে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের হীরকজয়ন্তী উদ্যাপন করতে আয়োজিত ওই টুর্নামেন্টে দল ছিল মাত্র ৫টি। যাদের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়েকে তখন কেউ গোনায়ই ধরত না। ভারত সেই ফাইনালও খেলতে পেরেছিল হয়তো সেমিফাইনালটা ওয়াংখেড়েতে হয়নি বলেই! সেমিফাইনালও ছিল ইডেনেই। যেটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শচীন টেন্ডুলকারের শেষ ওভার ভারতীয় ক্রিকেটে রূপকথা হয়ে আছে।
আগামীকালের ফাইনালে ধোনিদের না পেয়ে কলকাতার যে খুব মন খারাপ, তা না বললেও চলছে। ভারত সেমিফাইনালে ওঠার পরই ফাইনালের টিকিট নিয়ে ‘যুদ্ধ’ এখন স্তিমিত। পরশু রাতেও হোটেল বুকিংয়ের সাইটগুলোয় তিন তারকা থেকে পাঁচ তারকা প্রায় হোটেল ‘সোল্ড আউট’ দেখাচ্ছিল। কাল বিকেলে ইডেন থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা দূরত্বের হোটেলে চেক ইন করার সময় জানা গেল, বেশ কিছু বুকিং বাতিল হয়ে গেছে।
এই শহরকে একই দিনে আক্রান্ত করেছে যুগল দুঃখ। সেমিফাইনালের দিন দুপুরেই নির্মীয়মাণ উড়ালসেতু ধসে পড়ে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে ‘সিটি অব জয়’ থেকে কলকাতা যেন ‘সিটি অব সরো’তে রূপান্তরিত!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই দুঃখে কাতর হতে বয়েই গেছে। কাল সকালে মুম্বাই বিমানবন্দরে উচ্ছ্বসিত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান রেডিও সাংবাদিক বলছিলেন, ‘বছরটা দারুণ শুরু হলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে। এই বিশ্বকাপে ছেলে-মেয়ে দুটি দলই ফাইনালে। এটা খুব দরকার ছিল। গত বছরটা খুব খারাপ গেছে। চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ালিফাই করতে না পারাটা এখনো কেউ মেনে নিতে পারছে না।’
‘লাইন অ্যান্ড লেংথ’ নামে রেডিওর জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার। ধারাভাষ্যে প্রায়ই তাঁর সঙ্গী হচ্ছেন ক্লাইভ লয়েড। যাঁর কাছে পরশু রাতটা একটু বিশেষ কিছুই হয়ে থাকবে। সেটি শুধু তিনি সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান প্রধান নির্বাচক এ কারণে নয়। উত্তরসূরিদের উল্লাস দেখতে দেখতে লয়েডের নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল, এই মুম্বাইয়েই তাঁর টেস্ট অভিষেক। এ বছর যেটির সুবর্ণজয়ন্তী। পরশু ম্যাচ শেষে পুরোনো বন্ধু সুনীল গাভাস্কার মাঠেই অভিনন্দন জানালেন। দুজন পাশাপাশি গল্প করতে করতে হেঁটে গেলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। সেসব দিনের স্মৃতিচারণাই হয়তো হচ্ছিল।
একটা সময় ক্রিকেট-বিশ্বে প্রায় সবার ‘দ্বিতীয় প্রিয় দল’ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অনেক দিনই ওয়েস্ট ইন্ডিজ যা মনে করিয়ে দিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাসেরই জন্ম দেয়। তবে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ড্যারেন স্যামির দল ম্যাচ জেতার সঙ্গে সঙ্গে মনও জিতছে। তাদের কাছেই হেরে বিদায় নেওয়ার দুঃখ ভুলে ইডেনের তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষেই গলা ফাটানোর কথা।
ওয়াংখেড়ে-বিপর্যয়ের কাটাছেঁড়া হচ্ছে। হওয়ারই কথা। ভারতের বেশির ভাগ সংবাদপত্রই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। নো-বলে দুটি উইকেট বাতিল হয়ে যাওয়া, পরে বোলিং করার সময় শিশির-সমস্যা সবকিছু ছাপিয়ে প্রশ্ন উঠছে, বিরাট কোহলিকে দিয়ে কেন শেষ ওভারটা করালেন ধোনি? অতীতে এমন ফাটকা খেলে অনেকবারই জিতে গেছেন। যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে যোগিন্দর সিংকে দিয়ে শেষ ওভার করানো। লেগে গেলে প্রশংসা হবে, নইলে সমালোচনা—এটাই জগতের রীতি। তবে এখানে সমালোচনাটা শুধু সে কারণেই নয়। যোগিন্দর সিং তো তা-ও স্পেশালিস্ট বোলার ছিলেন। অশ্বিনকে না দিয়ে কোহলিকে দিয়ে শেষ ওভার করানোটা যে কোনো ক্রিকেটীয় যুক্তি-বুদ্ধির মধ্যেই পড়ছে না। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ধোনির ‘মজা’ও সমান আলোচিত। অবসর নিয়ে প্রশ্ন করায় এক অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিককে পাশে ডেকে নিয়ে তাঁকে দিয়েই উত্তরটা বলিয়ে ছেড়েছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের পর জেতার ধরন নিয়ে প্রশ্ন করায় এক ভারতীয় সাংবাদিককে তীব্র আক্রমণের সঙ্গে যেটিকে মিলিয়ে নিচ্ছে সবাই।
এসবের মধ্যে বাংলাদেশ আসার কথা ছিল না। আসছে মুশফিকুর রহিমের কারণে। কাল মুম্বাই থেকে নানা দেশি সাংবাদিকদের একটা বহর উড়ে এল কলকাতায়। ভারত হারায় উল্লাস প্রকাশ করে মুশফিকের টুইট তাঁদের মধ্যে তুমুল আলোচনার বিষয় হয়ে থাকল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে রেডিও সাংবাদিকের কথা বলা হলো, ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমন একজন সমর্থক পেয়ে তিনি বেজায় খুশি। কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকদের তা ভালো লাগবে কেন? তাঁদেরই একজন কণ্ঠে তীব্র ব্যঙ্গ মিশিয়ে বললেন, ‘ভারতের বিপক্ষে ওই সময়ে মুশফিক যে শট খেলে আউট হয়েছে, এর পর তাঁর বছর খানেক চুপ করে থাকা উচিত।’
মুশফিক কি বুঝতে পারছেন, তিনি আমজনতার একজন নন, তাঁর একটা টুইট বা ফেসবুক পোস্ট এখন আন্তর্জাতিক সংবাদ?