২০৩টি দেশ আর ৮২০টি ম্যাচ! বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের এই মহাযজ্ঞ পেরিয়েই চূড়ান্ত পর্বের টিকিট পেয়েছে মাত্র ৩২টি দল। এই ৩২ দল নিয়ে আমাদের নতুন ধারাবাহিক। চতুর্থ পর্বে থাকছে আইভরি কোস্ট—
১৩ জুলাই, ২০১৪। মারাকানা স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপের ফাইনাল। খেলার অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিট চলছে তখন। ইয়াইয়া তোরের পায়ে বল। প্রতিপক্ষের দুজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে ঠান্ডা মাথায় নিখুঁত একটি পাস দিলেন সলোমন কালুকে। অনেকখানি দৌড়ে ডিবক্সের সামনে কালু ক্রস দিলেন দ্রগবাকে। ভলি থেকে সেই গোলটি মিস করতে একটুও ভুল করলেন না দ্রগবা! বিশ্বকাপ জিতে গেল আইভরি কোস্ট!
না, চমকে উঠবেন না। এটা নিতান্তই কল্পিত একটা ছবিই ছিল। তবে ফাইনাল না হোক, অন্তত সেমিফাইনালে গিয়ে এরকম একটি অঘটন ঘটার স্বপ্নই যে দেখছে আইভরি কোস্টের মানুষ। দিদিয়ের দ্রগবা, সলোমন কালু, জারভিনহো ও তোরে ভাইদের নিয়ে একটি ‘সোনালি প্রজন্ম’ই পেয়েছে আফ্রিকান হাতিরা। কিন্তু এই দলটির নামের পাশে নেই বড় কোনো সাফল্য, এটা খুবই বেমানান।
সাফল্য থাকবেই বা কীভাবে, দেশের মানুষের প্রত্যাশার ভারে যে বড় মঞ্চে গিয়ে বরাবরই হোঁচট খায় দলটি। দিদিয়ের দ্রগবা। পুরো আফ্রিকার গর্ব। সুপারম্যান কিংবা স্পাইডারম্যানের চেয়ে কোনো অংশেই তিনি কম নন আইভরি কোস্টের মানুষের কাছে। ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসেও দলটির সবচেয়ে বড় তারকা খেলোয়াড়। দলে তাঁর উপস্থিতিই যেন অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী! হয়তোবা আগের মতো সেই ক্ষিপ্রতা নেই, নেই সেই শারীরিক সক্ষমতাও।
কিন্তু দ্রগবা শুধু একটি নাম নয়। প্রতিপক্ষকে দুশ্চিন্তায় ফেলে রাখতে এই একটি শব্দই যথেষ্ট। এ পর্যন্ত দলের হয়ে ৯৯ ম্যাচে ৬৩ গোল করেছেন। আইভরি কোস্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা দ্রগবার ওপরেই অনেকটা নির্ভর করছে আফ্রিকান দলটির বিশ্বকাপ সাফল্য-ব্যর্থতা।
দলটিতে আছেন ইয়াইয়া তোরের মতো অসাধারণ খেলোয়াড়। টানা তৃতীয়বার সেরা আফ্রিকান ফুটবলারের পুরস্কার জিতেছেন এই ৩১ বছর বয়সী সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। তোরেকে বলা হয় একজন ‘আন্ডাররেটেড’ খেলোয়াড়; যাঁর নাম ম্যাচ-প্রিভিউতে থাকে কম, কিন্তু ম্যাচ চলাকালে ভাষ্যকারের মুখে সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায়। তোরের অসাধারণ পারফর্মেন্সে সওয়ার হয়েই ম্যানচেস্টার সিটি জিতেছে এবারের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা।
বল পজেশন, শারীরিক সক্ষমতা, গোলক্ষুধা, ঠান্ডা মাথার নিখুঁত সব পাস—তোরেই যেন আফ্রিকান দলটির মূল ইঞ্জিন। প্রতিপক্ষের চোখ রাখতে হবে সলোমন কালুর দিকেও। দ্রগবার স্কিল এবং কালুর ক্ষিপ্রতা—এই জুটি হয়ে উঠতে পারে যেকোনো দলের জন্যই ভয়ংকর। একসময় চেলসির হয়ে খেলা এই তারকা এখন খেলছেন ফ্রান্সের লিলের হয়ে। এখানে পারফরম্যান্স অতটা ধারাবাহিক না হলেও বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ৭ ম্যাচে ৫ গোল করে কালু জানিয়ে দিয়েছেন, দেশের জার্সি গায়ে তিনি কতটা কার্যকর!
বিশ্বকাপে আলো ছড়ানোর জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন জারভিনহো। আর্সেনালের হয়ে হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন ইতালির রোমাতে। সৃজনশীলতা ও বিধ্বংসী দৌড় এই তারকার মূল শক্তি, এই বিশ্বকাপে তিনিই হয়ে উঠতে পারেন আইভরি কোস্টের তুরুপের তাস। ডিফেন্সে আছেন জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা দিদিয়ের জকোরা। তার সঙ্গে আইভরি কোস্টের দেয়াল হয়ে দাঁড়াবেন লিভারপুলের হয়ে খেলা কোলো তোরে। জকোরা-তোরে জুটির অভিজ্ঞতার প্রাচীর ভাঙা প্রতিপক্ষের জন্য কঠিনই হবে বৈকি।
দলটির কোচ হিসেবে আছেন সাবরি লামোউচি। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব শুরুর সপ্তাহ খানেক আগে দলটির দায়িত্ব নেন। ফ্রান্সের এই সাবেক মিডফিল্ডারের রয়েছে অসাধারণ ফুটবলপ্রজ্ঞা। দলের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই।
১৪ জুন জাপানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে আফ্রিকার হাতিদের এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ মিশন। গ্রুপ ‘সি’তে অন্য সঙ্গী দুটি দল কলম্বিয়া ও গ্রিস।
বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতা: এই নিয়ে টানা তৃতীয়বার বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছে দলটি। ২০০৬ ও ২০১০—দুটি বিশ্বকাপের কোনোটিতেই প্রথম রাউন্ডের চৌকাঠ পার হতে পারেনি। অবশ্য ভাগ্যও ততটা সুপ্রসন্ন ছিল না দলটির। ২০০৬ সালে তাদের গ্রুপসঙ্গী ছিল আর্জেন্টিনা ও হল্যান্ড। ২০১০ সালেও একই অবস্থা। এবারের গ্রুপসঙ্গী ব্রাজিল ও পর্তুগাল! এবার অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে দলটি।
শক্তি: সাফল্যের জন্য চোয়ালবদ্ধ হওয়া। দলটির সিনিয়র খেলোয়াড়দের অনেকের জন্যই এটা শেষ বিশ্বকাপ। শেষ বিশ্বকাপটায় নিশ্চিতভাবেই নিজেদের নিংড়ে দেবেন দ্রগবারা।
দুর্বলতা: বড় মঞ্চে প্রত্যাশার ভারে নুয়ে পড়া। দলের মাঝে ব্যক্তিত্বের সংঘাত নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে আইভরি কোস্ট। দলের অনেকেই ফুটবলীয় বিচারে বুড়ো; আইভরি কোস্ট গতিশীল খেলা উপহার দিতে পারবে কি না—তা নিয়েও আছে সংশয়।
দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শিশুমৃত্যুর চড়া হার, নিরক্ষরতা, অনাহার, দুর্নীতি, অপশাসন, বঞ্চনা, গৃহযুদ্ধ, লুট, দুর্দশা, মানবেতর জীবন যাপন—এসব নিয়েই গড়ে উঠেছে আফ্রিকা মহাদেশ নামের ইমারত। আইভরি কোস্টও এর ব্যতিক্রম নয়। গৃহযুদ্ধের ক্ষত থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তবে পিচঢালা পথ কিংবা ছোট্ট মাঠ, সবখানেই সুযোগ পেলে মেতে ওঠে তারা একটুখানি আনন্দে। এ আনন্দের নাম ফুটবল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে একই সুতোয় বেঁধে ফেলা—এটাই বোধ হয় ফুটবলের মাহাত্ম্য! বিগেস্ট শো অন আর্থে দ্রগবাদের শেষ পদার্পণ; এই বিশ্বকাপ রোমাঞ্চকর না হয়েই পারে না!