অভিজ্ঞতা, সময়মতো ঠিক কাজটি করার সামর্থ্য, ব্যক্তিগত প্রতিভা—ফুটবল মাঠে সাফল্যের আবশ্যকীয় উপাদান এগুলো। সুইজারল্যান্ডের চেয়ে তা বেশিই আছে আর্জেন্টিনার। মঙ্গলবার রাতে জয়ী দলের নাম তাই আর্জেন্টিনা; সুইজারল্যান্ড নয়।
লিওনেল মেসির মতো ফুটবলার আসলে যে দলে আছেন, জয়ের মালা তাঁদের গলাতেই মানায়। তাঁর প্রশংসায় নতুন শব্দ পাচ্ছি না। পরশু সুইসদের বিপক্ষে শেষ ষোলোর লড়াইয়ে কড়া পাহারায় ছিলেন। নিজের মতো করে খেলার জায়গা পাচ্ছিলেন না। কিন্তু মেসি ঠিকই জায়গা তৈরি করে নিলেন।
যত পাহারাই থাক, মেসিকে আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব। দলকে বিশ্বকাপের শেষ আটে তুলতে মেসির প্রয়োজন ছিল একটা দৌড়, ঠিকই তা করার জন্য জায়গাটা বানিয়ে নিয়েছেন। গোলের ঠিকানা লেখা চূড়ান্ত পাসটা বের করে মেসি বুঝিয়ে দেন, কেন তিনি মেসি।
প্রশংসা করা উচিত অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ারও। প্রতিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ডে এদিন বেশ কার্যকর লাগল তাঁকে। বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করছিলেন আন্তরিকভাবে। পোস্টে শট নিয়েছেন, সতীর্থদের অনেক বল বাড়িয়েছেন। ম্যাচের একমাত্র গোলের ফিনিশিংটাও করেছেন দারুণ। মেসির পাস, ডি মারিয়ার মাটি কামড়ানো প্লেসিং—চোখে লেগে থাকবে অনেক দিন। ডি মারিয়ার ছন্দে ফেরা আর্জেন্টিনার জন্য আশীর্বাদ। আগের ম্যাচেও তাঁকে আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল।
শেষ আটে ওঠার এমন স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচে গ্যাগোদের বেশ উদ্যমী লাগল। উইং প্লেটা ভালো হয়েছে। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ অবধি আর্জেন্টিনার খেলাটা অনেক ধারালো লাগল এ ম্যাচে। সামনের দিকে কার্যকর পাস খেলেছে তারা অনেক, ভুল পাসের সংখ্যাও তুলনামূলক কম ছিল। এ কারণেই আর্জেন্টিনার খেলাটা এদিন খারাপ লাগেনি। প্রথম তিন ম্যাচের চেয়ে ভালো অবশ্যই।
তার পরও সত্যি কথা বলতে, এখনো ঠিক নিজেদের সাবলীল ফুটবলটা খেলতে পারছে না আর্জেন্টিনা। কিছু সমস্যা রয়েই গেছে। রক্ষণ নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে কোচ সাবেলার। সুইসদের আক্রমণের মুখে প্রথমার্ধে বেশ কয়েকবারই খেই হারাল তাঁর রক্ষণ। একবার বাঁচালেন গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরা। সুইসরা ফাইনাল পাসটা ভালো করতে পারছিল না বলে রক্ষা। নইলে আর্জেন্টিনাকে মাশুল দিতে হতো। সব দিক ভেবেই রক্ষণ নিয়ে সংযত লাগল আর্জেন্টাইন কোচকে। হাভিয়ের মাচেরানো খুব একটা উচ্চাভিলাষ নিয়ে ওপরে যাননি, আক্রমণে তাঁর যোগদান খুব প্রয়োজন ছাড়া সেভাবে চোখে পড়েনি। হতে পারে, রক্ষণটাকে আঁটসাঁট রেখে খেলতে চেয়েছে আর্জেন্টিনা।
সুইজারল্যান্ড তো সেটা আরও বেশি করে চেয়েছে। সফলও হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে সুইসদের রক্ষণ অনেক বেশি বাধার দেয়াল তুলতে পেরেছে, ফুটবলের ভাষায় যেটা ব্লক করা। ফাইনাল পাস নিয়ে তাই বেরোতে পারছিলেন না ডি মারিয়ারা। গোল পেতে আর্জেন্টিনার লাগল ১১৮ মিনিট।
সুইস গোলরক্ষক ভালো খেলেছেন। তিনি একা নন, এবারের বিশ্বকাপে প্রায় সব গোলরক্ষকই দুর্দান্ত খেলছেন। গোলরক্ষকদের বিপক্ষে গোল করা যেন কঠিনতম কাজ এবার! ব্রাজিল বিশ্বকাপটা এখন মনে হচ্ছে গোলরক্ষকদের বিশ্বকাপ—এমনটা বললেও বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না।
প্রসঙ্গটা টানলাম পরশু রাতে যুক্তরাষ্ট্রের গোলরক্ষক টিম হাওয়ার্ডের বীরত্ব দেখে। দলটাকে একাই তিনি টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। গ্লাভসে যেন চুম্বক লাগানো ছিল। বেশ কয়েকবার দলকে বাঁচিয়েছেন নিশ্চিত গোল থেকে। এই বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ সেভ করলেন তিনিই—১৬টি। কিন্তু বেলজিয়াম লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে আক্রমণের পর আক্রমণের ঢেউ তুলে উপভোগ্য ম্যাচে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে।
এই বিশ্বকাপে বেলজিয়ামকে কালো ঘোড়া বলা হচ্ছে। তকমাটা কেন দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধ ভেঙে শেষ আটে ওঠার মধ্যেই উত্তরটা মিলছে। ব্যক্তিগত দক্ষতায় বেলজিয়ামের খেলোয়াড়েরা বিশ্বমানের। ইউরোপের বড় বড় লিগে দাপিয়ে খেলেন। কিন্তু একটা দল হিসেবে খেলার জন্য যে বোঝাপড়া দরকার, সেটার ঘাটতি দেখলাম। ফলে প্রতিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ডে এসে অনেকবারই খেই হারিয়েছে ওরা। হ্যাজার্ডের ওপর নির্ভরতাও একটু বেশি মনে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কিছু সাধারণ ভুল করায় ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত বের করে নিতে পেরেছেন লুকাকু অ্যান্ড কোং। শেষ আটে প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা, বেলজিয়ামের বড় পরীক্ষাটা সেদিনই।