বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের প্রসার ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উৎকর্ষের যুগে বদলে গেছে খেলা দেখার উপায়। একই সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট, রাগবি, বাস্কেটবল প্রভৃতি খেলায় আয়ের পথেও পরিবর্তন আসছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্রীড়াক্ষেত্রে আয়ের মূল খাত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে দর্শক-অনুরাগী ও ভক্তরা। তাই ভক্তদের দলে টানার জন্য বিভিন্ন খেলার মধ্যে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। ইদানীং তা ‘ভয়ংকর’ রূপ নিয়েছে।
ফুটবল হোক বা ক্রিকেট, খেলার প্রাণ দর্শকেরাই। দর্শক ও পাঁড় ভক্ত না থাকলে খেলার বাণিজ্যলক্ষ্মী দেখা দেন না। ফলে খেলার পৃষ্ঠপোষণা চালানোও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বিভিন্ন খেলার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখন নতুন ভক্তের সন্ধানে মেতেছে। কারণ নতুন ভক্ত মানেই অর্থের নতুন উৎস। তাতেই লাভ। প্রযুক্তির কল্যাণে খেলা দেখতে এবং এর পূঙ্ক্ষানুপুঙ্খ জানতে এখন আর মাঠে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন পড়ে না। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছে ফিফা, আইসিসি ও অন্যান্য ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বর্তমান বিশ্বে চিত্তবিনোদনের দুনিয়ায় খেলার দর্শকই সবচেয়ে বেশি। সেদিক থেকে আয়ের অঙ্কটাও বিশাল। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হলো—দর্শক খাত থেকে আসা রাজস্বের পরিমাণ এখন আগের তুলনায় কমতে শুরু করেছে। প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার বা পিডব্লিউসি নামের একটি বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বলছে, দর্শকদের মনোযোগ এখন খেলা থেকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। তারা খেলায় সময় কাটানোর পরিবর্তে বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমে মনোযোগ দিচ্ছে। ফিউচারস স্পোর্ট নামের আরেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বলছে, খেলার প্রতি দর্শকদের ব্যয় করা সময়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল ও রাগবির মতো খেলাগুলো এখন দর্শক ও ভক্ত টানার প্রতিযোগিতায় আরও আগ্রাসী হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দর্শকেরা অনেক বেশি অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। মানুষের কাছে চিত্তবিনোদনের উপায় এখন অনেক। আছে হাজার হাজার চ্যানেল, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আছে স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট। এসব উৎসে আছে বিনোদিত হওয়ার নানা উপায়। ফলে শুধু ক্রীড়াজগতের ওপর আর কাউকে নির্ভর করতে হচ্ছে না। তাই খেলার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেও বিপণনের নতুন কৌশল খুঁজতে হচ্ছে। এরই মধ্যে এই পথে বেশ কিছুটা এগিয়েছে ক্রিকেট। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কথা মাথায় রেখে একটি ম্যাচের উল্লেখযোগ্য অংশের ছোট ছোট ক্লিপিংস আলাদাভাবে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে লাভবান হয়েছে ক্রিকেট।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের কলেজ অব দা হলি ক্রসের ক্রীড়া অর্থনীতিবিদ ভিক্টর ম্যাথিসন বলছেন, ক্রিকেটের মতো ফুটবল, রাগবি ও বাস্কেটবলও বিপণন প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে ক্রীড়া বাণিজ্যের মোট অঙ্কটা বিশাল, বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি ডলার। সুতরাং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অর্থই হলো নগদ প্রাপ্তি।
মফেটনাথানসন নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে এখনো সবচেয়ে বেশি দর্শক টানে সরাসরি সম্প্রচারিত খেলা। মেসি বা রোনালদোর খেলা ম্যাচে যে পরিমাণ দর্শক টেলিভিশন বা অনলাইন স্ক্রিনের সামনে থাকে, তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি। শুধু ফুটবল নয়, অন্যান্য খেলার যে কোনো হাই ভোল্টেজ ম্যাচেই দর্শক উপস্থিতি থাকে চোখ কপালে তোলার মতো। কোনো নাটক-সিনেমার এখনো সেই সাধ্য হয়নি যে ক্রীড়া দর্শকদের ছিনিয়ে নেবে!
ফুটবল এ ক্ষেত্রে একমেবাদ্বিতীয়ম। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ক্রীড়া বাণিজ্যের অনেকাংশই তাই ফুটবলের দখলে। প্রতি বছর ফুটবল একাই প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলার রাজস্ব আয় করে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আমেরিকান ফুটবল। অথচ এর রাজস্ব আয় ফুটবলের অর্ধেক। বাস্কেটবলের তুলনায় ফুটবলের আয় প্রায় পাঁচগুণ বেশি, আর ক্রিকেটের তুলনায় অঙ্কটা ২০ গুণ! বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসাব বিবেচনায় নিলে বলা যায় যে, চলতি শতকের শুরু থেকেই ফুটবলের ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে। এর প্রধান কারণগুলো হলো—ফুটবল খেলা তুলনামূলক সহজ, নিয়মকানুন জটিল নয় এবং ক্রিকেটের মতো দুদিন পর পর সেগুলো বদলায় না। ২০০০ সাল থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা নতুন নতুন অঞ্চলে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় এবং বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে। এসব অঞ্চলে নতুন বাজার সৃষ্টি করাই ছিল ফিফার লক্ষ্য। এসব পদক্ষেপে ফুটবলের দর্শকও বেড়েছে ব্যাপক হারে। আর তাই নারীদের ফুটবলের বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টও এখন ১০০ কোটির বেশি মানুষ দেখে। প্রচলিত বাজারের বাইরে চীন ও আমেরিকাতেও বেড়েছে ফুটবলের জনপ্রিয়তা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বদলেছে ক্রিকেট, রাগবি ও বাস্কেটবল। বাণিজ্যের কথা ভেবেই ক্রিকেটে শুরু হয়েছে ২০ ওভারের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। পাঁচ দিনের টেস্ট বা ৮ ঘণ্টার ওয়ানডে ম্যাচের বদলে তাই এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তিন ঘণ্টার ম্যাচকে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির সদস্য দেশগুলোতেও টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজনের জোয়ার উঠেছে। ক্রিকেটের পাশাপাশি রাগবি ও বাস্কেটবলেও চালু হয়েছে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ম্যাচ। মূলত দর্শকদের আগ্রহের কথা ভেবেই প্রচলিত নিয়মকানুন পরিবর্তন করা হচ্ছে। কারণ দর্শক থাকলেই তো কড়ি জুটবে! না হলে সব ফক্কা।
এভাবে ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ক্রিকেট। হিসাব বলছে, আয় বৃদ্ধির হারের দিক থেকে গত এক দশকে শীর্ষে রয়েছে ক্রিকেট। মূলত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের দর্শক শ্রেণি দিয়েই বাজিমাত করেছে ক্রিকেট। ফুটবল যেভাবে নতুন নতুন এলাকায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে, ক্রিকেট সেদিক থেকে অনেক রক্ষণশীল।
ব্রিটিশ সাময়িকী দা ইকোনমিস্ট বলছে, কিছু নির্দিষ্ট বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকা দোষের কিছু না হলেও, এই কৌশল ঝুঁকিপূর্ণ। ক্রিকেট বাদে আর সব খেলাই নিজেদের ছড়িয়ে দেওয়ার প্রকল্প নিয়েছে। ফুটবলের বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে যেমন আগের চেয়ে বেশি দলকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বাস্কেটবল ২০০২ সালের পর থেকে বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। রাগবি বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৪ করার ভাবনা চলছে। এ ক্ষেত্রে সমীকরণ স্পষ্ট—যত বেশি দল খেলবে, তত বেশি দর্শক খেলা দেখবে। আর তাতেই বাজার বাড়বে। তাই অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন অঞ্চলে বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের কৌশলও নেওয়া হচ্ছে।
তবে বিশ্বকাপ বাদেও খেলা ছড়িয়ে দেওয়ার উপায় আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর জন্য অঞ্চল বা দেশভিত্তিক টুর্নামেন্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া জনপ্রিয় টুর্নামেন্টগুলোর ম্যাচও ভিন্ন অঞ্চলে আয়োজন করা যেতে পারে। ফুটবল, বাস্কেটবল ও রাগবি এরই মধ্যে এই কৌশলে সাফল্য পেয়েছে। এতে খেলাগুলোর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। নতুন অঞ্চলে খেলা ছড়িয়ে দেওয়ার সুবিধা সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে বাস্কেটবল। ফুটবলের দেখানো পথে হেঁটে বাড়তি রাজস্ব আয়ের দিক থেকে তরতরিয়ে এগোচ্ছে বাস্কেটবল। ধারণা করা হচ্ছে, আসছে বছরগুলোতে লাভের গুড়ের ভাগও বাস্কেটবলই বেশি পাবে। তখন হয়তো জনপ্রিয়তায় ফুটবলের পরই উচ্চারিত হবে বাস্কেটবল।
একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্যই দর্শক টানার ইঁদুরদৌড়ে শামিল হবে ফুটবল-ক্রিকেট-বাস্কেটবল-রাগবি। সেই প্রতিযোগিতায় ধাক্কাধাক্কিও হবে, থাকবে ল্যাং মারার খেলাও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে তারাই টিকে থাকবে। শঙ্কা হলো, বিপণনের প্রতিযোগিতায় না আবার খেলার আদর্শই হারিয়ে যায়!