ক্যাসিনোয় আয় কোটি টাকা, মাঠের খেলায় লবডঙ্কা

ইয়ংমেনস ক্লাব এখন ফুটবলার তৈরির কারখানা নয়। জুয়াড়িদের অভয়ারণ্য। ছবি: প্রথম আলো
ইয়ংমেনস ক্লাব এখন ফুটবলার তৈরির কারখানা নয়। জুয়াড়িদের অভয়ারণ্য। ছবি: প্রথম আলো

কয়েক দিন ধরেই খবরের শিরোনামে ঢাকার ক্লাবপাড়া। নাহ্, খেলাধুলা-সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে নয়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলো খবরে এসেছে জুয়া-ক্যাসিনোর কারণে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, আরামবাগ, দিলকুশা কিংবা ইয়ংমেনস ক্লাব ফকিরেরপুল যে দেশের খেলার জগতের নামকরা সব ক্লাব—এসব ভুলেই গেছেন ক্লাবকর্তারা। তারা এগুলোকে পরিণত করেছেন জুয়ার অভয়ারণ্যে।

খেলার ক্লাবে ক্যাসিনো দেখে দেশের মানুষ অবাক। কী শান-শওকত সেই ক্যাসিনোগুলোর! জুয়া খেলার আধুনিকতম সব উপকরণে ঠাসা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখলে বিভ্রম হতে পারে বিদেশের কোনো নাইটক্লাব ভেবে। যারা ক্যাসিনো-জুয়া-হাউজি ইত্যাদি দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করে, খেলার মাঠে তাদের অবস্থা কী! মোহামেডান ১৭ বছর ধরে লিগ জেতে না, ভিক্টোরিয়া-ওয়ান্ডারার্সের মতো ক্লাবগুলোর নাম তো মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছে। ইয়ংমেনস ফকিরেরপুল এক সময় ছিল দেশের ফুটবলে তরুণ প্রতিভা জোগান দেওয়ার কারখানা। এ প্রজন্ম জানে না দিলকুশা স্পোর্টিং এক সময় দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে খেলত। ক্যাসিনো-সংস্কৃতি এ ক্লাবগুলোতে খেলাধুলাকে পরিণত করেছে অনগ্রাধিকারের বিষয়ে।

মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, ইয়ংমেনস, দিলকুশা, আরামবাগ—বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের নামকরা এই ক্লাবগুলোর মাঠের অবস্থা কী, সেদিকে চোখ ফেরালে শঙ্কিতই হবেন খেলাপ্রেমীরা

ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব
বিশ্বস্ত সূত্র থেকেই জানা যায় মতিঝিল ক্লাব পাড়ায় নিজেদের তাঁবুতে প্রথম ক্যাসিনো চালু করে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। তারা এ ক্ষেত্রে অন্যদের ‘পথপ্রদর্শক’। কিন্তু মাঠের খেলায় ভিক্টোরিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। ঢাকার অন্যতম পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাবটি বড় দল হিসেবেই এক সময় পরিচিত ছিল। তবে সেটি স্বাধীনতার আগে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভিক্টোরিয়ার মাঠের দাপট ধীরে ধীরে কমেছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে মাঝারি মানের দল হিসেবে তারা টিকে ছিল। ২০০৭ সালে পেশাদার ফুটবল লিগ চালু হওয়ার পর ভিক্টোরিয়া তাতে খেলার সুযোগ পায়নি কোনো বারই। এখন তারা খেলে প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে।
সে তুলনায় ক্রিকেটে ভিক্টোরিয়ার অবস্থা ভালো ছিল। ২০০২ ও ২০০৩ সালে টানা দুইবার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভিক্টোরিয়া। এরপর থেকে ভিক্টোরিয়া নিচের দিকেই গেছে। গত মৌসুমে প্রথম বিভাগ থেকেও তারা নেমে গেছে দ্বিতীয় বিভাগে। হকি দলও তাদের টিকে আছে কোনোমতে।

খেলার ক্লাবগুলোর অবস্থা এখন এমনই। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা ওয়ান্ডারার্স
এক সময়ের ঢাকার ফুটবলের জায়ান্ট বলা হতো তাদের। আবাহনী, ব্রাদার্স তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ওয়ান্ডারার্স নিয়মিতই লিগ শিরোপা জিতেছে। ভিক্টোরিয়ার মতোই স্বাধীনতার পর থেকে জৌলুশ কমতে থাকে তাদের। তবে অনেক দিন দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছে তারা। ২০০৩-০৪ মৌসুমে শেষবার প্রিমিয়ার লিগে খেলা ওয়ান্ডারার্সকে এই প্রজন্ম ভুলেই গেছে। ভিক্টোরিয়া তা-ও প্রিমিয়ারের দ্বিতীয় স্তরে খেলে, ওয়ান্ডারার্সের পাত্তা নেই কোথাও।
ক্রিকেটে তারা খেলে দ্বিতীয় বিভাগে। হকিতেও বলার মতো কিছু নেই ওয়ান্ডারার্সের।

ইয়ংমেনস ক্লাব ফকিরেরপুল
ইয়ংমেনসকে এক সময় বলা হতো তরুণ প্রতিভা সৃষ্টির কারখানা। দেশের ফুটবলের অনেক বড় বড় তারকার উত্থান এই ইয়ংমেনস ক্লাবে খেলার মধ্য দিয়ে। তরুণ প্রতিভাবান ফুটবলারদের নিয়ে লিগের বড় বড় দলের সঙ্গে লড়াই করত ফকিরেরপুলের এই ক্লাবটি। ১৯৮৮ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে আসার পর সেরা সাফল্য ১৯৯৫ সালের প্রিমিয়ার লিগে চতুর্থ স্থান। তবে এরপর থেকেই নিচের দিকে তাদের গ্রাফ। ২০০৭ সালে পেশাদার ফুটবল লিগ চালু হওয়ার পর ইয়ংমেনসের হলুদ জার্সি দেখা যায়নি। তবে ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে শিরোপা জিতে প্রিমিয়ারে জায়গা করে নেওয়ার পরেও ‘টাকা নেই’ এই অজুহাতে নাম প্রত্যাহার করে নেয় দলটি। আপাদমস্তক ফুটবল দিয়েই পরিচিত ইয়ংমেনস কখনোই অন্য কোনো খেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে নাম লেখায়নি।

মোহামেডানের ঐতিহ্য মিশে গেছে ধুলায়। ছবি: প্রথম আলো

আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ
‘ক্যাসিনো’ ক্লাবগুলোর মধ্যে খেলাধুলায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে আরামবাগ। মাঝে প্রিমিয়ার থেকে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে কয়েকবার ওঠানামা করলেও ২০১৬ সাল থেকে তারা প্রিমিয়ার লিগে নিয়মিত। হালে ফুটবলের ক্লাবটির বিনিয়োগ প্রশংসিতও হচ্ছিল। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, খেলোয়াড়-কোচদের বড় অঙ্কের অর্থে মূল্যায়ন, নতুন খেলোয়াড় তৈরির একাডেমি প্রতিষ্ঠা—আরামবাগ রীতিমতো উদাহরণই তৈরি করে যাচ্ছিল। ২০১৮ সালে স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে অবাক করে দেয় তারা। ক্যাসিনোর আয় তারা ফুটবলে বিনিয়োগ করেছে সচেতনভাবেই।

মোহামেডান স্পোর্টিং লিমিটেড
বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির সাফল্য তাদের নিয়মিতই ছিল। লাখ লাখ সমর্থকের আবেগের নামও মোহামেডান। ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে ১৯৫৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মোহামেডান অন্তত ১৯ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ঘরোয়া টুর্নামেন্ট জিতেছে অজস্রবার। আন্তর্জাতিক ফুটবলেও মোহামেডানের সাফল্য আছে ধারাবাহিকভাবে। বিদেশে খ্যাতিসম্পন্ন এই ক্লাব ১৭ বছর ধরে লিগ শিরোপা জেতে না। দেশের ফুটবলের শীর্ষ খেলোয়াড়দের অনেকেই মোহামেডানে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অভিযোগ আছে, খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক নিয়ে ঝামেলা করার। অপেশাদার আর ভুঁইফোড় ক্রীড়া সংগঠকদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠা মোহামেডান খবরে ক্লাবে পুলিশি অভিযানকে কেন্দ্র করে। মাঠের খেলার অবস্থা যাচ্ছেতাই হলেও সেখানে রমরমিয়ে চলে ক্যাসিনো ব্যবসা।
ফুটবলে ২০০২ সালে শেষবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোহামেডান। অবস্থা খারাপ ক্রিকেটেও। ২০০৯ সালে শেষবার প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা জিতেছিল তারা। এখন মাঝারি মানের দল হিসেবেই ক্রিকেটে মোহামেডান ধুঁকে যাচ্ছে। হকিতে অবশ্য সে হিসেবে তাদের অবস্থান ভালো। শেষবার হকি লিগে শিরোপাই জিতেছে তারা।

দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব
দিলকুশা টানা দুই বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠেছে প্রথম বিভাগে। শেষ মৌসুমে হকিতেও প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লিগে নাম লিখিয়েছে তারা।