দুয়ারে বিশ্বকাপ। এ উপলক্ষে বিশ্বকাপের সেরা ১০ কিংবদন্তির সঙ্গে পাঠকদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আমরা। আজ থাকছে জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে নিয়ে বিশেষ রচনা—
বেকেনবাওয়ার বিশ্বকাপকে মহিমান্বিত করেছেন নাকি বিশ্বকাপ বেকেনবাওয়ারকে মহান করেছে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে সন্দেহাতীতভাবেই এই জার্মান কিংবদন্তি বিশ্বকাপের এক সেরা চরিত্র। জার্মান ফুটবলে তিনি ‘কাইজার’ নামে পরিচিত, সম্মানিত। তাঁর ফুটবল প্রতিভা, প্রজ্ঞা আর অর্জন—সবকিছুর জন্যই তিনি ‘কাইজার’ বা ‘সম্রাট’। দুটি বিশ্বকাপ রয়েছে তাঁর নামের পাশে। ১৯৭৪ সালে অধিনায়ক হিসেবে তত্কালীন পশ্চিম জার্মানিকে এনে দিয়েছিলেন ফুটবলের সেরা এই অর্জন। ১৯৯০ সালে তিনি জার্মানিকে আরও একবার শিরোপা জেতান, কোচের ভূমিকায়, নেপথ্য নায়ক হিসেবে। ব্রাজিলের মারিও জাগালোর সঙ্গে যৌথভাবে এই মর্ত্যের মাত্র দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে খেলোয়াড় এবং কোচ উভয় ভূমিকায় বিশ্বকাপ বিজয়ের এক বিরল অর্জন কাইজারের। তবে অধিনায়ক এবং কোচ হিসেবে এই রেকর্ড একান্তই বেকেনবাওয়ারের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে দিকে জার্মানির মিউনিখে জন্ম গ্রহণ করেন বেকেনবাওয়ার। ১৯৬৫ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সেই বেকেনবাওয়ারের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় পূর্ব জার্মানির বিপক্ষে। তিনটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন পশ্চিম জার্মানির হয়ে। একই দলের হয়ে দুটি বিশ্বকাপে ছিলেন কোচ হিসেবেও। বার্লিন দেয়ালের ভেঙে জার্মানির একীভূত হওয়ার কিছুদিন আগে জার্মানদের আরও একটি বিশ্বকাপ উপহার দেন কোচ হিসেবে। পশ্চিম জার্মানি তথা জার্মানির তিন বিশ্বকাপ জয়ের দুটিতেই আছে বেকেনবাওয়ারের অনন্য অবদান।
মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা বেকেনবাওয়ার শেষ পর্যন্ত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন রক্ষণভাগের একজন অদ্বিতীয় সেনাপতি হিসেবে। রক্ষণের খেলোয়াড় হিসেবে বিপ্লব ঘটান রক্ষণের পেছনের ‘রক্ষাকবচ’ নামে পরিচিত আধুনিক ফুটবলের সুইপার বা লিবারো হিসেবে। রক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার কঠিন দায়িত্বের পাশাপাশি প্রতিপক্ষের দুর্গে আঘাত হানার কাজটিও বেকেনবাওয়ার করে যেতেন অপূর্ব কারিশমায়। ১৯৬৬ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই বেকেনবাওয়ার একজন মিডফিল্ডার হিসেবে চার গোল করে সবার নজর কাড়েন। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে ওয়েম্বলির ঐতিহাসিক ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের গোলে পরাজিত হলেও তরুণ বেকেনবাওয়ার মাথা উঁচু করেই দেশে ফেরেন।
১৯৭০-এর পরের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ২-০-তে পিছিয়ে থেকেও ৬৯ মিনিটে বেকেনবাওয়ারের গোলে জার্মানি ঘুরে দাঁড়ায়। নির্ধারিত সময়ে ২-২-এ সমতার ম্যাচে পশ্চিম জার্মানি শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময়ের গোলে জিতে যায়, শোধ নেয় এর আগের বিশ্বকাপের পরাজয়ের। তবে সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষে সেই ’গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’র ম্যাচে অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে বেকেনবাওয়াররা ৪-৩ গোলে পরাজিত হয়। গুরুতর আহত হন তিনি। কাঁধ থেকে হাত লড়ে যায় তাঁর। কিন্তু বদলি খেলোয়াড়ের কোটা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ভাঙা হাত নিয়েই খেলে যান তিনি।
১৯৭৪-এর পরের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় বেকেনবাওয়ারের পশ্চিম জার্মানিতেই। দান দান তিন দানে হয়তো বিশ্বাস রেখেছিলেন বেকেনবাওয়ার। নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ, দেশবাসীর সমর্থন, মুলার-ব্রেইটনালদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী দল সর্বোপরি ২৯ বছর বয়সীর হয়তো ছিল নিজের সেরাটা দেওয়ার শেষ সুযোগ। এবার আর কোনো ভুল হয়নি। এবার কেবল মাথা উঁচু করেই ক্ষান্ত হননি বেকেনবাওয়ার, দুই হাতে উঁচু করে ধরেছিলেন বিশ্বকাপ ট্রফিটিই। বিশ্বকাপ জয়ের পথে বেকেনবাওয়ারদের রক্ষণ শিরোপার অন্যতম দাবিদার ইয়োহান ক্রুইফের টোটাল ফুটবলকে বাক্সবন্দী করে রেখে ২-১-এ জয় ছিনিয়ে নেয় হল্যান্ডের বিপক্ষে।
তিনবার বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফিটি ব্রাজিল রেখে দেওয়ার পর বিশ্বকাপের নতুন ট্রফি বিজয়ী প্রথম দলনেতা বেকেনবাওয়ার। শুধু তাই না, তাঁর নেতৃত্বেই ইউরো এবং বিশ্বকাপ জেতা প্রথম দলের গৌরব অর্জন করে পশ্চিম জার্মানি। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসের নিয়ে ফিফা যে ‘ড্রিম টিম’ করে তাতে বেকেনবাওয়ার নির্বাচিত হন একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে। দুবারের ইউরোপ-সেরা ফুটবলার বেকেনবাওয়ার পশ্চিম জার্মানির হয়ে খেলেছেন ১০৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। প্রথম জার্মান ফুটবলার হিসেবে শততম ম্যাচের মাইল ফলক তাঁর ক্যারিয়ারের এক অনন্য অর্জন।
বেকেনবাওয়ারের হাত ধরেই আসে পশ্চিম জার্মানির তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। ১৯৯০ সালের সেই শিরোপা জয়ের সময় বেকেনবাওয়ার তখন কোচ। তাঁর অধীনে ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপের ফাইনালও খেলে জার্মানি। তবে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার কাছে সেবার পরাজিত হলেও ’৯০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে সেই ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই বিশ্বকাপ ইতিহাসে নিজের অমরত্ব নিশ্চিত করেন বেকেনবাওয়ার।