>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অনুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এই সময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো
খেলোয়াড় থেকেই আজ আমি আমিনুল, খেলোয়াড় হিসেবেই লোকে আমাকে চেনে। ওই অনুভূতি, ওই ভালোলাগা এখন মনের ভেতর একটু বেশিই কাজ করছে। একান্তে বসে ভাবতে পারছি আমি কী ছিলাম, অতীতে কী করেছি। দৈনন্দিন ব্যস্ততা নেই। সকালে বাসা থেকে বেরুনোর তাড়া নেই। অথচ এমনিতে অনেক সময় দম ফেলারও ফুসরত ছিল না।
কখনো ভাবিনি এভাবে বাসায় বন্দি থাকতে হবে। কিন্তু কিছু করার নেই। আর এটা তো একটা সুযোগও। পরিবারকে সময় দিতে না পারার আক্ষেপ এবার দূর হলো। আমার ছেলের অনেক প্রশ্ন আর কৌতুহল মেটাতে পারছি। ষষ্ট শ্রেণী পড়ুয়া ছেলের ফুটবল নিয়ে বেশ আগ্রহ। আমাকে অনেক কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে। আমি কীভাবে খেলতাম, কীভাবে অনুশীলন করতাম, কোচেরা কীভাবে আমাকে দেখতেন। তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমিও অতীতে ফিরে যাই। খেলা নিয়ে গল্প করি।
অনেক সময় পুরনো জার্সি বা বিশেষ কোনো বল নেড়েচেড়ে দেখি। নষ্টালজিক হয়ে পড়ি তখন। তবে সময়টা বেশি কাটে আসলে এক বছর সাত মাস বয়সী আমার ছোট মেয়ের সঙ্গে । বড় মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ওকেও সময় দিই। গল্প করি।
আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। রোজার সময়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই। এখন যেহেতু মসজিদে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাই বাসাতেই নামাজ পড়তে হয়। মিরপুরে আমাদের বাড়িতে আমরা তিন ভাই, ভাতিজারা ৫ ওয়াক্ত নামাজই বাড়ির দোতলায় মেঝভাইয়ের বাসায় জামাতে পড়ি।
খেলা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি আগেই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। করোনার সময় আমারও দায়িত্ব শ্রমজীবি মানুষের পাশে দাঁড়ানো, যারা আর্থিক সংকটে আছে। আমি চারটি ওয়ার্ডে কষ্টে থাকা মানুষদের নানাভাবে সহায়তা করছি। আমার লোকজন বাসায় বাসায় চাল, ডাল, আটাসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আসছে। এটা বেশ আগেই শুরু হয়েছে। পুরো রমজান মাসেই চলবে। এগুলো তদারকি করতেও অনেকটা সময় চলে যায়। আমি মনে করি, একজন নাগরিক হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব।
তবে এই সময় যেন আরও বেশি করে মিস করছি ফুটবল মাঠ, ফুটবলার জীবনের নানা সাফল্য—ব্যর্থতার দিনগুলো। ২০০৩ সালে ঢাকায় আমরা প্রথমবার সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতলাম। ফাইনালে টাইব্রেকারে মালদ্বীপের একটি শট আমি সেভ করেছিলাম। ফাইনালের ভিডিওটা কদিন আগে কারা যেন ফেসবুকে পোস্ট করেছে। এটা নিয়ে অনেকের অনেক মন্তব্য, বেশ ভালোই লেগেছে।
২০০৯ সালে প্রথম সুপার কাপ জয়ের ক্ষণটাও ভীষণ মিস করি। মোহামেডান আহামরি দল না হলেও আমরা সেবার চ্যাম্পিয়ন হই। সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে ২—৩টা সেভ করে মোহামেডানকে পার করে দেই। টুর্নামেন্টজুড়েই আমি দারুণ ছন্দে ছিলাম। বর্তমান প্রজন্ম এগুলো দেখেনি। তাই বুঝবে না কেমন ছিল সেই দিনগুলো।
২০১০ সালে ঢাকায় সাফ গেমসে চ্যাস্পিয়ন হলাম। কোচ জোরান জর্জেভিচের কথা মনে পড়ে। পাগলা টাইপের মানুষ। কিন্তু অনেক আন্তরিক ছিলেন। মনেই হতো না লোকটা ভিনদেশি। কয় দিন আগে কথা হচ্ছিল জর্জ কোটানের সঙ্গে। ২০০৩ সালে তাঁর কোচিংয়েই আমরা সাফ জিতেছিলাম। করোনার অপ্রত্যাশিত অবসরে পুরোনো কোচ, সতীর্থ সবার কথাই কমবেশি মনে পড়ছে।
আরেকটা ব্যাপার আমাকে খুব ভাবায়। আমাদের নাজুক চিকিৎসা ব্যবস্থা কবে শক্তিশালী হবে! আমি মনে করি, রাজনীতিবিদেরা যতদিন তাঁর নিজের বা পরিবারের চিকিৎসা দেশে না করাবেন, ততদিন আমরা পিছিয়েই থাকব। এটা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। কোনো রাজনৈতিক চিন্তা থেকে বলছি না। সাধারণ নাগরিক হিসেবেই এই দুঃসময়ে এটা আমার উপলদ্ধি।
বেশি খারাপ লাগছে এটা দেখে যে, করোনা ভাইরাসের কারণে মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছি আমরা। বাবার মৃতদেহ দেখতে যাচ্ছে না ছেলে। মৃতদেহ অবহেলায় পড়ে থাকছে। পরিবার পর্যন্ত পাশে থাকে না মৃত ব্যক্তির। এগুলো দেখে মাঝে মাঝে আসলেই হতাশ হয়ে পড়ি। ভাবি, এ আসলে কীসের লক্ষণ!