>বিশ্বকাপে বাবা ও ছেলের দুজনেরই খেলার উদাহরণ আছে। ভাইদের খেলার ঘটনা তো অসংখ্য। বিশ্বকাপে ‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ে লিখেছেন ফেরদৌস রহমান
গুরুজনদের দেখানো পথে হাঁটাই ভালো। এ কথা আর কেউ মানুক না-মানুক, স্যাম কারেন এখন নির্ঘাত মানেন। ইংল্যান্ডের এই অলরাউন্ডার মাঝে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন। বাঁহাতি পেস বোলার, সে সঙ্গে ব্যাট হাতে বেশ ঝড়ও তুলতে পারেন। টেস্ট ক্রিকেটে সে ক্ষমতা দেখিয়েছেন, ওই বাঁ হাতেই। মানে ক্রিকেটটাকে একেবারে বাঁ হাতের খেলই বানিয়ে ফেলেছেন স্যাম। ওদিকে তাঁর বড় ভাই কিন্তু ওসব ঝামেলায় যাননি, ব্যাটিং আর বোলিং দুটোই ডান হাতেই করতে পছন্দ করেন টম।
পেস বোলিং আর ব্যাটিং—দুটোই ডান হাতে করার বুদ্ধিটা টম বাবার কাছেই শিখেছেন। গুরুজনদের মান্য করার ফলই হবে হয়তো, পাদপ্রদীপের আলোয় স্যাম থাকলেও বাবা কেভিনের পথ ধরে বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছেন ওই টমই। যদিও দলটা ভিন্ন দুজনের। টম ইংল্যান্ডের ২০১৯ বিশ্বকাপ স্কোয়াডের গর্বিত সদস্য হলেও বাবা কেভিন ৩৬ বছর আগে সে স্বাদ পেয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের হয়ে। ১৯৮৩ সালের পর ১৯৮৭ বিশ্বকাপেও খেলেছেন কেভিন। টম চাইলে অবশ্য স্যামকে সান্ত্বনা দিতে পারেন, ‘আরে চার বছরের ছোট তুই, চার বছর পরেই নাহয় বিশ্বকাপ খেলবি!’
সবাই অবশ্য গুরুজনদের অনুসরণ করেও ফল পান না। বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ খেলানোর নায়ক আকরাম খানের মতোই ডানহাতি ছিলেন নাফিস ইকবাল। কিন্তু চাচার মতো বিশ্বকাপ খেলার সৌভাগ্য হয়নি নাফিসের। অথচ বাঁহাতি তামিম ইকবাল কিন্তু শুধু বিশ্বকাপ খেলেনইনি, বিশ্বমঞ্চে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে আকরাম খানকে টপকে গেছেন তাঁর ভাতিজা। এ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মূল ভরসা ভাই-চাচাকে সব ক্ষেত্রেই টপকে যাওয়া তামিমই।
টপকে যাওয়ার গল্পে অবশ্য মিচেল মার্শের ওপরে কেউ নেই। আট বছরের বড় ভাইয়ের তিন বছর পর আন্তর্জাতিক অভিষেক। ব্যাটিং দক্ষতায় বড়জনের ধারেকাছেও নেই। অথচ মিচেলই কি না বড় ভাইকে টপকে শুধু বিশ্বকাপই খেলেননি, ছুঁয়ে ফেলেছেন বাবা জিওফ মার্শকেও। ২০১৫ বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের সদস্য ছিলেন মিচেল। মিচেলের জন্মের চার বছর আগেই অবশ্য সে স্বাদ পেয়ে গেছেন জিওফ মার্শ। এবার বাপ-ভাইকে ছোঁয়ার অপেক্ষায় আছেন শনও। ৩৫ বছর বয়সে অবশেষে ভাগ্যকে সঙ্গী পেয়েছেন, ২০১৯ বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া দলে আছেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
ক্রিকেট খেলাটাকে পারিবারিক ব্যাপার বানিয়ে ফেলায় অবশ্য এমনিতেও অস্ট্রেলিয়ানদের জুড়ি নেই। সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই তো এসব চলছে! সেবার ইয়ান চ্যাপেলের নেতৃত্বে বিশ্ব শাসন করতে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ব্যাটিংয়ে যদিও মূল ভরসার নাম ছিলেন অন্য চ্যাপেল—গ্রেগ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের শিরোপা উৎসব দেখার পর আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি দুই ভাইয়ের। বিশ্বকাপ না জেতার দুঃখটা ভাগাভাগি করে হালকা করে নিতেই কি না কে জানে, ছোট ভাই ট্রেভরও তাঁদের সঙ্গী হয়েছেন ১৯৮৩ সালে। ব্যাটিং দক্ষতায় দুই ভাইয়ের ধারেকাছে না থাকলেও ট্রেভর একটি ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছেন বড় দুজনকে। বিশ্বকাপে চ্যাপেল পরিবারের একমাত্র সেঞ্চুরি তাঁরই!
অস্ট্রেলিয়ার পরিবারতন্ত্র নিয়ে কথা উঠলেই এ দুজনের নাম আসতে বাধ্য। হাজার হলে ক্রিকেট তো যমজ ভাই দেখে খুব একটা অভ্যস্ত নয় (নিউজিল্যান্ডের মার্শাল ভাইদের কথা আলাদা)! স্টিভ ও মার্ক ওয়াহরা ক্রিকেটের একটি যুগেরই নাম। ব্যাটিং সৌন্দর্যে ছোটজনই এগিয়ে ছিলেন সব সময়। বিশ্বকাপে রান তোলায়, সেঞ্চুরি করায়ও। কিন্তু একটি মাত্র সেঞ্চুরিতেই যে বিশ্বকাপের গতিপথ বদলে দিয়েছিলেন স্টিভস। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে হেডিংলিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরি তাঁর ইস্পাতদৃঢ় চরিত্রেরই একটা প্রতীকী চিত্র হয়ে আছে। বাড়তি এই গুণের কারণেই মার্কের চেয়ে একটি বিশ্বকাপ বেশি খেলেছেন (৪টি), একটি বিশ্বকাপও বেশি জিতেছেন স্টিভ।
পরিবারতন্ত্রে ওয়াহদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও বিশ্বকাপ জেতা ক্লাবের পুনর্মিলনীতে ঠিকই লি পরিবার বীরদর্পে ঢুকতে পারে। গতির তোড়ে ব্রেট লি সবার মন থেকে তাঁর নাম হয়তো ভুলিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু স্টিভ ওয়াহর ১৯৯৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের ছবিটিতে একটু খুঁজলেই লি ভাইদের বড়জন শেনের দেখা পাবেন। ডেভিড হাসি অবশ্য অতটা ভাগ্যবান নন। বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেললেও বড় ভাই মাইক হাসির মতো বিজয়ীর পদক গলায় ঝোলানোর সৌভাগ্য তাঁর হয়নি।
ক্রিকেটে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দেখানোয় অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে এগিয়ে ছিল দুটি দেশ। তারা এবার বিশ্বকাপেই নেই। না হলে জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া এবারও নির্ঘাত পারিবারিক আবহে বিশ্বকাপ খেলত। পুরো একটা দশক জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের ভার টেনেছেন দুই ভাই। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের মুখ হয়ে ওঠা গ্রান্ট ফ্লাওয়ার ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের কথা যদি মনে না থাকে, তবে আপনার নিজেকে অপরাধী ভাবা উচিত। বিখ্যাত ভাই হ্যামিল্টনের ধারেকাছে না থাকলেও শিঙ্গি মাসাকাদজা কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলেছেন বড় ভাইয়ের আগে। তাঁদের মাঝেই পল স্ট্র্যাং ও ব্রায়ান স্ট্র্যাংয়ের নাম ভুলে গেলেও কেউ সম্ভবত তেড়ে আসবে না।
পলের লেগ স্পিনকে ভুলে গেলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট–ভক্তরা কেনেডি ওটিয়েনোকে ভুলতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশকে তো কম যন্ত্রণা দেননি এই ওপেনার। শেষ দিকে নিজের পারিবারিক উপাধি ‘ওবুইয়া’ নিয়ে খেলেছেন কেনেডি। ২০০৩ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলার পেছনে অবশ্য কেনেডি নয়, কলিন্স ওবুইয়ার ভূমিকাই বেশি ছিল। নিজেদের ইতিহাসের সেরা টুর্নামেন্টে সেবার কেনিয়া দলে আরও এক ওবুইয়া (ডেভিড) ছিল! কেনিয়ার সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় স্টিভ টিকোলো। ১৯৯৬ সালে ভাই ডেভিডের সঙ্গেই বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল তাঁর।
এ বিশ্বকাপে সুযোগ পেলে বিস্ময়ের জন্ম দিতেন স্টুয়ার্ট ব্রড, সেটা হয়নি। তবে টানা তিনটি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলের পেস বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন এই পেসার। স্টুয়ার্ট না থাকলেও তাঁর বাবা ক্রিস ব্রড এই বিশ্বকাপেও আছেন। ম্যাচ রেফারি ক্রিসের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ অবশ্য নতুন নয়, সেই ১৯৮৭ সাল থেকেই আছেন বিশ্বকাপের সঙ্গে। সেবার অবশ্য দুই দলের খেলোয়াড় বা তাঁদের আচরণ নয়, নিজের ব্যাটিংয়েই ছিল তাঁর সব মনোযোগ।
বিশ্বকাপে বাবা–ছেলের কথা বললে অবশ্য সবার আগে বলা উচিত ডন আর ডেরেক প্রিঙ্গলের নাম। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপে ইস্ট আফ্রিকার পক্ষে খেলেছিলেন ডন প্রিঙ্গল। সেই ইস্ট আফ্রিকা দলটি গড়া হয়েছিল কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া ও জাম্বিয়ার ক্রিকেটারদের নিয়ে। ডন প্রিঙ্গল তখন কেনিয়ায় থাকতেন, ছেলে ডেরেক প্রিঙ্গলের জন্মও কেনিয়ায়। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের পক্ষে খেলে যিনি গড়েন বাবা–ছেলের বিশ্বকাপ খেলার প্রথম উদাহরণটি।