বিশ্বকাপের দলগুলো

এশিয়ার কালো ঘোড়া

বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের টিকিট পাওয়ার পর ইরানের উল্লাস
বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের টিকিট পাওয়ার পর ইরানের উল্লাস

২০৩টি দেশ আর ৮২০টি ম্যাচ! বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের এই মহাযজ্ঞ পেরিয়েই চূড়ান্ত পর্বের টিকিট পেয়েছে মাত্র ৩২টি দল। এই ৩২ দল নিয়ে আমাদের নতুন ধারাবাহিক। প্রথম পর্বে থাকছে ইরান

ইরান—দেশটির নাম শুনলেই পাঠকের মনে অবিচল আহমেদিনেজাদের চেহারা ভেসে ওঠে, পারমাণবিক বোমাসংক্রান্ত খবরাদির কথা মনে পড়ে কিংবা মনে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের কথা। প্রতিনিয়ত নানা রাজনৈতিক-সামাজিক-ধর্মীয় ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শিরোনাম হতে হয় ইরানকে। ইরান কিন্তু আরেকটি কারণে হতে পারে শিরোনাম। ফুটবলের কারণে, ফুটবলের প্রতি দেশটির আপামর মানুষের ভালোবাসার কারণে।

ইরানের কোচ কার্লোস কুইরোজ যেমন বলেছেন, ‘ইরান হচ্ছে সেই দেশগুলোর মাঝে একটি, যাদের ডিএনএর মাঝেই আছে ফুটবলের জন্য ভালোবাসা। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা জার্মানির মতো এখানকার মানুষেরাও ফুটবলের জন্য পাগল। খুব কম দেশেই দেখবেন স্টেডিয়ামে খেলা দেখার জন্য এক লাখেরও বেশি মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে। যে রাতে আমরা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলাম, সে রাতে সাড়ে ছয় কোটিরও বেশি মানুষ রাস্তায় উদযাপন করছিল।’

ফুটবল বিশ্বে কিন্তু ইরান পরিচিত মুখই। সেই সত্তরের দশকে ইরানের হয়ে খেলেছেন এশিয়ার শতাব্দী-সেরা গোলরক্ষক নাসের হেজাজি, এশিয়ার পেলে নামে খ্যাত হাসান রওশান। সর্বশেষ প্রকাশিত ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ৩৭ নম্বরে আছে ইরান। ২০১৪ সালে চতুর্থবারের মতো দলটি বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে এশিয়ার স্বপ্নের সারথি হয়ে। ১৬ জুন নাইজেরিয়ার সঙ্গে ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে ইরানের এই বিশ্বকাপ মিশন। গ্রুপে ‘এফ’-এ ইরানের সঙ্গী অন্য দুটি দল আর্জেন্টিনা ও বসনিয়া-হার্জেগোভিনা। বাছাইপর্বে কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া, উজবেকিস্তানদের নিয়ে গড়া গ্রুপে কঠিন পরীক্ষা দিয়েই উত্তীর্ণ হয়েছে ইরান। নিজেদের শেষ তিনটি ম্যাচেই জয় পেয়েছিল ইরান, এর মধ্যে কাতার আর দক্ষিণ কোরিয়াকে তাদের মাঠেই হারিয়েছে কুইরেজের দল। যোগ্যতর দল হিসেবেই ইরান সুযোগ পেয়েছে বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে।

নিঃসন্দেহে দলটির সবচেয়ে বড় তারকা কোচ নিজেই। কুইরোজ রিয়াল মাদ্রিদকে কোচিং করিয়েছেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফার্গুসনের সহকারী হিসেবে ছিলেন দীর্ঘদিন, ছিলেন পর্তুগালের কোচও। তিন বছর আগে দায়িত্ব নিয়ে ইরান দলটির চেহারাই বদলে দিয়েছেন। আপস করেননি শৃঙ্খলার সঙ্গে। দলটির মাঝে এনেছেন বড় কিছু করার আত্মবিশ্বাস। বিশ্বকাপের ‘মিশন ইমপসিবল’-এর পরেই শেষ হতে চলেছে কুইরেজোর ইরান-অধ্যায়। প্রিয় কোচকে নিশ্চিতভাবেই দারুণ বিদায়ী উপহারই দিতে চাইবেন শিষ্যরা।

দলটিতে বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের আছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতা। দলের মূল খেলোয়াড় হিসেবে থাকছেন জাভেদ নিকৌনাম। দলটির অধিনায়কও তিনি। ওসাসুনায় খেলে আসা এই খেলোয়াড় জানেন কীভাবে বড় মঞ্চে সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়েও বাছাইপর্বে ৬ গোল করে দলকে তুলে এনেছেন বিশ্বকাপের মূল পর্বে। ফুলহামের হয়ে খেলা ডেজাগাহ হতে পারেন ইরানের সাফল্যের অন্যতম কারিগর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডেজাগাহ জার্মানির অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়েও খেলেছিলেন, কিন্তু কুইরেজের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ইরানের হয়েই খেলার সিদ্ধান্ত নেন। দুর্দান্ত স্ট্যামিনা ও গতি দিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণসীমানায় ত্রাস ছড়াতে পারেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। চোখ থাকবে সেন্টার ফরোয়ার্ড রেজার দিকেও। রেজা খেলছেন ইংলিশ দ্বিতীয় বিভাগের দল চার্লটন অ্যাথলেটিকে।

বাছাইপর্বের শেষ তিন ম্যাচে তিন গোল করে ভক্তদের জুগিয়েছেন প্রত্যাশার রসদ। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত মিডফিল্ডার তেইমুরিয়ানের ঝুলিতে আছে বোল্টন ও ফুলহামের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা। বদলি হিসেবে নেমে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন ফরোয়ার্ড করিম আনসারি। বড় মঞ্চে না খেলার অভিজ্ঞতাই ইরানকে অন্য দলগুলোর চেয়ে পিছিয়ে রাখছে অনেকাংশে। তা ছাড়া দলটির গড় বয়স ৩০-এর কাছাকাছি; যদিও কুইরেজ অগাধ আস্থা রাখছেন এই ‘বুড়ো’দের ওপরেই। দলটির সবচেয়ে বড় শক্তিমত্তা হচ্ছে এর জমজমাট ডিফেন্স।

হোসেইনি এবং মোনতাজেরি জুটির ইস্পাতদৃঢ় দেয়াল ভাঙা প্রতিপক্ষের জন্য কঠিনই হবে বৈকি। আগে অংশ নেওয়া তিনবারের বিশ্বকাপের প্রতিটিতেই প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছে ইরান। কিন্তু উপভোগের মূলমন্ত্র নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে খেলতে আসা দলটি হুমকিই হয়ে উঠতে পারে বাকি গ্রুপ প্রতিপক্ষদের জন্য। সর্বশেষ ১১ ম্যাচের ৮টিতেই যে জিতেছে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা ইরান!

কুইরোজ অবশ্য পা মাটিতেই রাখছেন। বলেছেন তাদের হারানোর কিছু নেই। কিন্তু কে না জানে এই ‘হারানোর কিছু নেই’ মানসিকতাই যে কোনো প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!