>অবিস্মরণীয় এক রাত কাটাল খেলাপ্রেমীরা। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস—সবকিছুর উত্তেজনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল একই রাতে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এমন রাত কবে এসেছিল শেষবার?
ক্রিকেটের নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ে লর্ডসে যখন ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড খেলছে, ঝকঝকে রোদ হাসছে আকাশে। ওদিকে একই শহরের অল ইংল্যান্ড টেনিস ক্লাবে ঘাসের কোর্টের দুই সেরা তারকার মধ্যে চলছিল উইম্বলডনের শিরোপা জেতার লড়াই। তার আরও কয়েক ঘণ্টা পরে আবার আফ্রিকান নেশনস কাপের সেমিফাইনালে লড়তে নেমেছিল আফ্রিকান ফুটবলের দুই পরাশক্তি আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়া। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ ম্যাচগুলো বাংলাদেশের খেলাপ্রেমীরা উপভোগ করেছেন সন্ধ্যা রাতে। যে ম্যাচগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কাল রাতে যেভাবে দর্শকদের স্নায়ু ক্ষয় করেছে, তা এক কথায় অবিস্মরণীয়। উত্তেজনায় নখ কামড়াতে থাকা আর ঘেমে-নেয়ে ওঠা এমন রাত শেষবার কবে এসেছিল বাংলাদেশের খেলাভক্তদের জীবনে!
সন্ধ্যাজুড়েই সবাই দোটানায় ছিলেন। একদিকে ক্রিকেট বলছে আমাকে দেখো, অন্যদিকে টেনিস বলছে, না আমাকে দেখো! সব দেখেশুনে ফুটবল বলছে, তাহলে আমি কী দোষ করলাম? আমাকে তোমার দেখতে ক্ষতি কোথায়? তর্কযোগ্যভাবে অবিস্মরণীয় আর খেলোয়াড়ি উত্তেজনায় ভরপুর এক রাত!
দেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় বেশি। তাই ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপ ফাইনালের দিকেই চোখ ছিল অধিকাংশ মানুষের। পুরো টুর্নামেন্টে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিংকে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন ব্যাট হাতে তেমন কিছু করতে পারলেন না, কিউইদের টানলেন ওপেনার হেনরি নিকোলস ও টম ল্যাথাম। ২৪১ রানে আটকে গেল কিউইদের ইনিংস। ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্যমাত্রা ২৪২ রানের। যে দলে জেসন রয়, জনি বেয়ারস্টো, জো রুট, এউইন মরগান, বেন স্টোকস, জস বাটলারের মতো ব্যাটসম্যান আছে, এই লক্ষ্যমাত্রা তো তাদের জন্য নস্যি!
ততক্ষণে উইম্বলডনের ফাইনাল শুরু হয়ে গেছে। মুখোমুখি আধুনিক যুগের দুই গ্রেট রজার ফেদেরার ও নোভাক জোকোভিচ। উইম্বলডনের সবচেয়ে সফল চ্যাম্পিয়ন বনাম উইম্বলডনের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। ওপেন যুগে ঘাসের কোর্টের সর্বকালের সেরা বনাম আগামীর সেরা। প্রথম সেটে লড়াই হলো সেয়ানে সেয়ানে। গড়াল টাইব্রেকারে। সেখানে একটুর জন্য ‘বুড়ো’ ফেদেরারকে পেছনে ফেললেন জোকোভিচ। তাতে ফেদেরারের আঁতে ঘা লাগল কি না, দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে এলেন আধুনিক যুগের টেনিস-সম্রাট। দাঁড়াতেই দিলেন না জোকোভিচকে। ৬-১ গেমে জিতে নিলেন দ্বিতীয় সেট।
ওদিকে ব্যাটিংয়ে নেমে গেছে ইংল্যান্ড। সেভাবে ঝড় তোলার আগেই ওপেনার জেসন রয়কে থামিয়ে দিয়েছেন ম্যাট হেনরি। পরে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়েছে ইংল্যান্ডের, একে একে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছেন বেয়ারস্টো, রুট ও অধিনায়ক মরগান। প্রয়োজনীয় রান রেট বাড়ছে তরতর করে। ক্রিজে তখন বেন স্টোকসের সঙ্গে জস বাটলার। এই জুটি যদি টিকতে পারে, ইংল্যান্ডের ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা আছে, না হলে নেই—সোজা হিসাব।
এদিকে পুরোনো আমের আচারের মতো মজে উঠছে ফেদেরার-জোকোভিচের ধ্রুপদি লড়াই। তৃতীয় সেটেও একইভাবে টাইব্রেকে জিতলেন জোকোভিচ, পরের সেটটা সরাসরি জিতে জবাব দিলেন ফেদেরার। সবার চোখ এখন পঞ্চম সেটে। এই সেটটা যে জিতবে, শিরোপা তার। একটা করে গেম ফেদেরার জিতছেন, তো পরেরটা জোকোভিচ। জোকোভিচ এক পয়েন্টে এগিয়ে যাচ্ছেন তো পরের মুহূর্তেই ‘এইস’ দিয়ে সমান-সমান করে নিচ্ছেন ফেদেরার। ম্যাচ জেতার জন্য প্রয়োজনীয় দুই পয়েন্টের ব্যবধান কেউই পাচ্ছেন না! কেউ কারে নাহি জিতে সমানে সমান!
লর্ডসে ততক্ষণে ইনিংস মেরামতের কাজটা বেশ ভালোভাবে করে ফেলেছেন বাটলার আর স্টোকস। দুজনই তুলে নিয়েছেন ফিফটি। জুটি ১১০ রানের। যেই মনে হওয়া শুরু করল যে না, আস্তে আস্তে এই জুটির ওপর ভর করেই নিজেদের ইতিহাসের প্রথম শিরোপা জিতবে নিউজিল্যান্ড, বাগড়া দিলেন লকি ফার্গুসন। নিউজিল্যান্ডের এই গতিতারকার এক স্পেলেই নির্ধারিত হয়ে যাবে ম্যাচের ফলাফল, সেটা ম্যাচ শুরুর আগেই বলে রেখেছিলেন মার্ক নিকোলাস, গৌতম গম্ভীর, ডিন জোন্স, ইরফান পাঠানের মতো ক্রিকেট বিশ্লেষকেরা। সেটাই হলো। ছোট এক ঝড়ে তুলে নিলেন উইকেটে থিতু হয়ে থাকা বাটলার আর সদ্য ক্রিজে আসা ক্রিস ওকসকে। ব্যস, ম্যাচ জমে ক্ষীর!
ওদিকে ফেদেরার-জোকোভিচ ফাইনালও জমে ক্ষীর হয়ে গেছে বহু আগে। ম্যাচ জেতার ওপর বাঁচা-মরা নির্ভরশীল, দুজন এমনটা ভেবেছিলেন কি না কে জানে! পাল্টাপাল্টি গেম জিতেই চলছিলেন দুজন। এমন অবস্থায় দুই-দুইবার শিরোপা জেতার হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে এলেন ফেদেরার। আর একটা পয়েন্ট জিতলেই ট্রফি ফেদেরারের!
কিন্তু না, জোকোভিচ এত সহজে হাল ছাড়বেন কেন? টানা সাত পয়েন্ট জিতে এবার ট্রফির হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে এলেন জোকোভিচ! এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় করতে করতে দুজনই শেষ সেটে বারোটা করে গেম জিতে ফেললেন! নিয়মানুযায়ী এখন টাইব্রেকে গড়াবে ম্যাচ!
ওদিকে নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড ম্যাচ চলে এসেছে শেষ ওভারে। শেষ ওভারে দরকার ১৫ রান। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে শুধুই স্টোকস। বিশ্বের দুই নম্বর বোলার ট্রেন্ট বোল্ট যখন বোলিং লাইনে এলেন শেষ ওভারটা করার জন্য, বিশ্বাস হয়নি তিনি ১৫ রান দিয়ে দেবেন যে। কিন্তু স্টোকস যে কাল নেমেছিলেন তিন বছর আগের করা একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য!
সেবার ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির ফাইনালের শেষ ওভারে টানা চার বলে চার ছক্কা মেরে ইংল্যান্ডের হাতের মুঠো থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ক্যারিবীয় কার্লোস ব্রাফেট। দুর্ভাগা বোলার ছিলেন এই স্টোকস। মাঠের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে স্টোকসের চোখমুখ ঢেকে কাঁদার ছবিটা এখনো ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে।
সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এই ফাইনালকেই বেছে নিয়েছিলেন স্টোকস। বোল্টকে টানা দুই ছক্কা মেরে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন ইংল্যান্ডকে। কিন্তু নাটকের যে আরও অনেক অঙ্ক বাকি ছিল!
ইংল্যান্ডের ইনিংসে জয়ের জন্য শেষ ৩ বলে দরকার ছিল ৯ রান। এমন পরিস্থিতিতে মার্টিন গাপটিলের থ্রো বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে বাউন্ডারি সীমানা টপকে যায়। আর ব্যাটসম্যানরা দৌড়ে ২ রান নেওয়ায় আম্পায়ার মোট ৬ রান যোগ করতে বলেন স্কোরবোর্ডে। শেষ দুই বলে পড়িমরি করে তিন রান নিতে গিয়ে দুই রান আউটের শিকার হলো কিউইরা। ম্যাচ টাই!
ওদিকে স্নায়ুর বারোটা বাজিয়ে দেওয়া ক উইম্বলডনের ফাইনালে দুইবার ফেদেরারকে চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্ট জিততে না দেওয়া জোকোভিচের শিরোপা জেতার জন্য ভাগ্যের অতটুকু আশীর্বাদেরই দরকার ছিল। আর কটা দিন পর ৩৮-এ পা দিতে যাওয়া ফেদেরার শেষ পর্যন্ত জোকোভিচের কাছে স্নায়ুর লড়াইয়েই হেরে গেলেন যেন। তর্কযোগ্যভাবে উইম্বলডনের ইতিহাসের সেরা ফাইনালে জয়ীর জায়গায় লেখা হলো সার্বিয়ান তারকার নাম। শেষ সেটের টাইব্রেকে ৭-৩ ব্যবধানে পরাজিত হলেন ফেদেরার। শেষ হলো ৪ ঘণ্টা ৫৭ মিনিটব্যাপী চলতে থাকা ধ্রুপদি এক লড়াই। উইম্বলডনের ইতিহাসে এত লম্বা ফাইনাল আর কখনো হয়নি!
লর্ডসে ওদিকে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড তখনো প্রস্তুতি নিচ্ছে ইতিহাসের প্রথমবার সুপার ওভারে গড়ানো ম্যাচ খেলার। ইংল্যান্ড ব্যাটিং করতে পাঠাল সেই স্টোকস-বাটলারকে। বোল্টের করা ওভারটায় দুটি চার মেরে ১৫ রান তুললেন দুজন। ১৬ রান করতে পারবে তো কিউইরা? বল করতে আসা জফরা আর্চার যে তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারে এক ওভারে কখনোই ১৬ রান দেননি!
আর্চার প্রথম বলটাই করলেন ওয়াইড। স্নায়ুচাপ? হবে হয়তো! এর ওপর জিমি নিশামের কাছে একটা ছক্কা খেয়ে আরও ব্যাকফুটে চলে গেলেন আর্চার। শেষ দুই বলে তখন তিন রান লাগে। মূল ম্যাচে ইংল্যান্ডের ইনিংসের শেষটার মতো দৃশ্যপট! পঞ্চম বলে এক রান নিয়ে সমীকরণটা এক বলে দুই রানে নিয়ে এলেন গাপটিল-নিশাম। শেষ বলটা ডিপ উইকেটের দিকে কোনোরকমে ঠেলে পড়িমরি করে ছুট লাগালেন গাপটিল। এক রান পেলেন, দ্বিতীয় রানটা নিতে গিয়ে হয়ে গেলেন রান আউট! ব্যস, সুপার ওভারেও টাই!
এমন ম্যাচে কেউ জয়ী বা পরাজিত থাকে না। তাও, ট্রফি তো কোনো এক দলকে দিতেই হবে, তাই বুঝি আইসিসি নিয়ম করে রেখেছিল, সুপার ওভারের পরেও ম্যাচ টাই হলে যে দল সবচেয়ে বেশি বাউন্ডারি মারবে, তারাই জিতবে। আর এ হিসাবে ইংল্যান্ড মেরেছে ২৪ বাউন্ডারি, নিউজিল্যান্ড ১৬টি। অর্থাৎ ইংল্যান্ডই জয়ী।
এমন মহাকাব্য তো খোদ ফেরদৌসী লিখে যাননি বোধ হয়!
ক্রিকেট-টেনিসের এই দিনে ফুটবল পিছিয়ে থাকবে, তা কি হয়? ফুটবলও ভাবল, ‘আমরাও আমাদের ঝলক দেখাই আজ একটু!’ এমন উত্তেজনাকর রাতে খেলাপ্রেমীদের জন্য ফুটবলের রসদ না থাকলে হয় নাকি!
ফাইনালের নিষ্পত্তি যখন হলো, আফ্রিকান নেশনস কাপের সেমিফাইনাল চলছে তখন। মুখোমুখি রিয়াদ মাহরেজ আর সোফিয়ানে ফেগহুলির আলজেরিয়া, আর জন ওবি মিকেল-আহমেদ মুসার নাইজেরিয়া। ম্যাচের ৪০ মিনিটে নাইজেরিয়ার ডিফেন্ডার উইলিয়াম ট্রুস্ট-একোংয়ের গোলে তখন এগিয়ে আছে আলজেরিয়া। ৭৩ মিনিটে পাওয়া পেনাল্টিতে নাইজেরিয়াকে সমতায় আনেন স্ট্রাইকার ওডিওন ইগহালো। মূল সময়ের সঙ্গে যোগ করা সময়ের একদম পঞ্চম মিনিটে ঠিক বক্সের বাইরে ফ্রি-কিক পায় আলজেরিয়া। ম্যানচেস্টার সিটির উইঙ্গার রিয়াদ মাহরেজ স্নায়ুর চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে সেখান থেকে গোল করে ম্যাচের একদম শেষ শটে দলকে তুললেন ফাইনালে!
এখন আপনিই বলুন, ক্রীড়ানৈপুণ্যে ভরপুর এমন রাত আগে কবে এসেছে?