রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত

এত দূরে এসেও টেলিভিশনে!

অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কেমন দেখলেন?
রিওতে অলিম্পিক কাভার করতে এসেছি। এটা তো আমার বলার কথা। কিন্তু আমার যে ভিন্ন কিছু বলার নেই। আপনারা যা দেখেছেন, আমিও তা-ই। টেলিভিশন তো আর একেক দেশে একেক রকম দেখায় না!
পার্থক্য বলতে, আপনারা দেখেছেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে বসে। আর আমি অলিম্পিক নগরীতে। মারাকানা থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে কোপাকাবানার এক হোটেলে। বিচিত্র অভিজ্ঞতাই বটে!
হোটেলে যখন চেক ইন করছি, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনো ঘণ্টা আড়াই বাকি। বিমানযাত্রার ধকলকে পাত্তা না দিয়ে মারাকানায় যাওয়ার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু শরীর আপত্তি জানাল। সঙ্গে মনও। অলিম্পিক মাত্র শুরু হচ্ছে। আগামী ১৬ দিন বিস্তর খাটাখাটনির ব্যাপার আছে। দুই বছর আগে ব্রাজিলে বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিভীষিকাময় সেই স্মৃতিও নিশ্চয়ই অবচেতন মনে কাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত তাই সিদ্ধান্ত, কোপাকাবানায় বড় পর্দায় আমজনতার সঙ্গে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার। রিওতে নেমেই জেনেছি, দুপুরে এই কোপাকাবানাতেই বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে। বিষয়টা রাজনৈতিক, তবে তা থেকে অলিম্পিক আয়োজনবিরোধী স্লোগানও উঠেছে। কোপাকাবানায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখলে অলিম্পিক নিয়ে সাধারণ ব্রাজিলিয়ানদের মনোভাবের একটা পরিচয় পাওয়া যাবে। সেই পরিকল্পনাও ব্যর্থ। কোপাকাবানায় যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো আয়োজনই নেই!
বিশ্বকাপের সময় বিশাল ফ্যান জোন করা হয়েছিল এখানে। বড় পর্দায় খেলা দেখতে ঢল নামত লাখো মানুষের। এবার তেমন কিছু নেই। অলিম্পিকের চিহ্ন অবশ্য আছে। বিচ ভলিবল হবে এখানেই। সেটির জন্য সৈকতে সারা গায়ে অলিম্পিকের আঁকিবুঁকি নিয়ে অপেক্ষা করছে অস্থায়ী স্টেডিয়াম। জড়াজড়ি করে থাকা পাঁচ গোলকের বিখ্যাত অলিম্পিক প্রতীকের সামনে ছবি তোলার ভিড়। এসবের সঙ্গে কোপাকাবানা তার চিরকালীন পর্যটক-প্রিয়তা নিয়ে রীতিমতো কোলাহলমুখর।
সেটির আকর্ষণ উপেক্ষা করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে হোটেলের রুমে দৌড়াতে হলো। সেখানে আবার আরেক বিপত্তি। হঠাৎ করেই ছবি চলে গিয়ে টেলিভিশন পরিণত হলো রেডিওতে! শুধু শব্দ শোনা যায়। যা শুনে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। ধারাভাষ্য যে পর্তুগিজে। রিসেপশনে ফোন করার পর একজন এসে রেডিও-টেলিভিশন ঠিক করার আদিমতম উপায়ের সাহায্য নিলেন। কিন্তু চড়থাপ্পড়েও ছবি ফিরল না। রুমে ঢুকে পুরোনো দিনের বিশাল পিকচার টিউবওয়ালা টেলিভিশন দেখে একটু বিরক্ত হয়েছিলাম। সবকিছুরই একটা ভালো দিক আছে। ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন—এটির যেমন প্রমাণ পাওয়া গেল এতেই। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আরেকটি টেলিভিশন চলে এল রুমে। দেয়ালে ফিট করার এলইডি বা এলসিডি টেলিভিশন হলে যা সম্ভব হতো না।
মাঝের সময়টায় খুব বেশি কিছু মিস হয়নি। ছবি চলে যাওয়ার সময় মার্চ পাস্ট চলছিল, তখনো সেটিই চলছে। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এটিই চলে। কারও কাছে ক্লান্তিকর লাগতেই পারে, তবে আমার এটি খুব ভালো লাগে। কত বিচিত্র দেশ, কত বিচিত্র বেশভূষা! অলিম্পিক যে শুধুই খেলার সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বমানবতার জয়গান গায়, তা তো এই মার্চ পাস্টেই সবচেয়ে বেশি মূর্ত হয়ে ওঠে।
নানাজনের হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত অলিম্পিক মশালটা কার হাতে জ্বলে, এটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটা বড় কৌতূহল হয়ে থাকে সব সময়। ব্রাজিলের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ পেলে যে নন, সেটি মোটামুটি আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে না পারার কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন পেলে। এটাই আসল কারণ হয়ে থাকলে ব্যাপারটা খুব নিষ্ঠুর হয়ে যায়, তবে একটা গুঞ্জন কিন্তু শোনা যাচ্ছে। স্পনসরশিপের কী একটা ঝামেলা থাকাতেই নাকি পেলে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। সকালে নাশতার টেবিলে এক ব্রাজিলিয়ানকে বলতে শুনলাম, কী এমন অসুস্থ যে মশালটাও জ্বালাতে পারবেন না। পার্কিনসনে বিপর্যস্ত মোহাম্মদ আলী কি কাঁপতে কাঁপতে আটলান্টা অলিম্পিকের মশাল জ্বালাননি!
শেষ পর্যন্ত যাঁর হাতে মশাল জ্বলল, সেটির একটা প্রতীকী অর্থ চাইলে খুঁজে নিতে পারেন। ভ্যানডারলেই করদেইয়ো ডি লিমা এমন কোনো বিখ্যাত নাম নন। তবে আলোচিত তো বটেই। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে ম্যারাথনে সবার সামনে ছিলেন। এক দর্শক আচমকা আক্রমণ করে না বসলে হয়তো সোনাও জিততেন। শেষ পর্যন্ত জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ। দর্শকের ওই আক্রমণের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে কি বর্তমানে অস্থির এই পৃথিবীর কথা মনে করিয়ে দিতে চাইলেন আয়োজকেরা! কে জানে, আমি হয়তো একটু বেশিই কল্পনা করে ফেলছি।
একটু আগে মোহাম্মদ আলীর ‘কাঁপাকাঁপি’র কথা লিখতে লিখতে মনে হলো, কাঁপাকাঁপির একটা টাটকা অভিজ্ঞতা দিয়েই শেষ করি এই ডায়েরি। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা টু দুবাই ফ্লাইট যাত্রাপথে হঠাৎই এমন লাফাতে শুরু করল যে, এ-যাত্রা অলিম্পিক দেখার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
আগের দিন দুবাই এয়ারপোর্টে ল্যান্ডিংয়ের সময় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এমিরেটসের একটি বিমান। যাত্রীরা যে সবাই বেঁচে গেছেন, তা একরকম অলৌকিক ঘটনা। যেটির জেরে ঢাকা থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে ফ্লাইট। দুর্ঘটনায় পড়া বিমানটি আসছিল কেরালা থেকে। আমার পাশের যাত্রীও যে কেরালার এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, এটির সঙ্গে আমি দুইয়ে-দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলে এই জীবনে কী পেয়েছি কী পাইনি তার একটা চূড়ান্ত হিসাব মিলিয়ে ফেললাম। পিংপং বলের মতো লাফাতে থাকা বিমান মিনিট দশেক পর শান্ত হলো। এতেই আমার জানা হয়ে গেল, ১০ মিনিট সময় কখন ১০ ঘণ্টা মনে হয়!