গোটা দলের স্কোর বোর্ডে রান যখন ১০৩, তখন নির্দিষ্ট এক ক্রিকেটারের ৫১ রানের ইনিংস কি খুশি হওয়ার মতো কিছু হতে পারে!
তবুও স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথম দিনের ৩২.৫ ওভারের ইনিংসে এক প্রাপ্তির নাম সাকিব আল হাসান। ব্যাটসম্যান সাকিব নাকি অধিনায়ক সাকিব?
আবার পেলেন অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব। আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে গেলেন, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁর জন্য বিশেষ এক জায়গা। ২০০৭ বিশ্বকাপে শুরু। এরপরে অনেকবার নিজে সফর করেছেন, খেলেছেন ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগও৷
তবে সাকিবের মনে বিশেষ স্থান পাওয়ার কথা তো কেমার রোচকে লং অনে মারা সেই বিশাল ছয়৷ ভুলে যাওয়ার কথা কি এমন ছয়? ২০০৯ সালে প্রথমবার বিদেশের মাটিতে টেস্ট ম্যাচ, সিরিজ জয় বলে কথা৷ হোক না বেতন-ভাতা বিতর্কে মাঠে নেমেছিল উইন্ডিজের ‘বি’ দল। গোটা সিরিজে ১৫৯ রান আর ১৩ উইকেট নিয়ে সাকিব তো দেখিয়ে দিলেন, ২২ বছর বয়সেও এভাবেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া যায়৷ আবার সেই উইন্ডিজ, আবার অধিনায়ক সাকিব।
বঙ্গোপসাগরের বহু জল গড়িয়েছে, সাকিবও এই ১৩ বছরে দেখে ফেলেছেন ক্যারিয়ারের অনেক রং৷ বদলায়নি শুধু প্রতিপক্ষ বোলারের নামটা—কেমার রোচ৷ ছিলেন না স্কোয়াডে, হুট করে ফিরলেন একেবারে ম্যাচের আগের দিন।
বাংলাদেশের বিপক্ষে এই পেসারের সাফল্য উইন্ডিজের নির্বাচকদের ভালোই জানা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিম ইকবাল সর্বোচ্চ ১১ বার আউট হয়েছেন কেমার রোচের বলে। টেস্টে আউট হয়েছেন চারবার, এর চেয়ে বেশি তামিমকে আউট করেছেন শুধু ডেল স্টেনই। শুধু এক তামিম কেন?
স্কোয়াডে থাকা বাকিরাও রোচের বলে ভুগেছেন একই তালে। টেস্টে সাকিব চারবার, মুমিনুল হক দুবার আউট হয়েছেন রোচের বলে।
এবারও অ্যান্টিগার সুন্দর সকালে বাংলাদেশের রাতের মতো ইনিংসটাকে কালো করেছেন কেমার রোচই ৷ উইকেট মাত্র দুটিই পেয়েছেন, প্রথম দুই ব্যাটসম্যানের। তবে যে ভয়টা ধরিয়ে দিয়ে গেছেন, সেটাই ক্ষতি করল ওই দুটি উইকেটের চেয়ে অনেক বেশি। স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে চার বছর আগে ৪৩ রানে গুটিয়েছে বাংলাদেশ দল৷ এবারও জেগেছিল ওই শঙ্কা। শুধু এক সাকিব ছিলেন বলে রক্ষা। আর তাই তো ১০৩ রানে প্রথম ইনিংস থামার পরেও এমন অরণ্যে রোদন!
যখন সাকিব উইকেট আসেন, মাহমুদুল, নাজমুল, মুমিনুলের পর তামিমও ড্রেসিংরুমে৷ স্ট্রাইকে যাওয়ার আগে দেখলেন, ফর্মের তুঙ্গে থাকা লিটনও একই পথের পথিক৷
ক্যারিয়ারে চড়াই-উতরাই দেখেছেন অনেক, সঙ্গে ঝুলিতে দেড় দশকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা। ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল খেলাটা দেখাচ্ছে না। মাধ্যম ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইট। মাঠেও দর্শক নেই তেমন, ক্রিকেটারদের যেকোনো কথাই কানে ভেসে আসে খুব স্পষ্ট করে।
নুরুল হাসান সোহান উইকেটের আসার পর সাকিব বললেন, ‘হঠাৎ একটা আসে ভেতরে, বাকি সব বাইরে...’ বোলার কাইল মায়ার্স করলেনও তাই। দারুণ এক ইনসুইঙ্গার, নুরুল হাসান সোহান বল ছাড়লেন আর লেগ বিফোরের ফাঁদে৷ ইশ্, সোহান যদি সাকিবের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন! দলের স্কোরবোর্ডে তাহলে ৪৫/৬ না হয়ে ৪৫/৫-ই থাকত। সোহানের নিজেরও টেস্ট প্রত্যাবর্তন ইনিংসটা শূন্য রানের বেশি হতো।
ব্যাটসম্যান সাকিব নিজের মতোই। পুরোনো হয়ে যাওয়া তাঁর কথাটার মতোই, ‘আমি এভাবেই খেলি...।’ আলজারি জোসেফকে লেগ সাইডে ২ রান নিয়ে শুরু। ৬ বলে ২ রান থেকে দেখতে দেখতে ১২ বলে ১১ রান৷ ‘অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’—সাকিবের চেয়ে এই তত্ত্ব আর কে বেশি মানেন বাংলাদেশ দলে!
কাইল মায়ার্সকে লং অফে ছয় মেরেছেন। অনেক দিন পর সাকিবের ব্যাটে ছয়, শেষবার মেরেছিলেন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ২০১৭ সালে৷ মাঝে পেরিয়েছে ১৯২৩ দিন আর ২২ ইনিংস।
মধ্যাহ্নবিরতির পর ফিরেছেন মিরাজ, মোস্তাফিজও। উইকেটে আসা ১০ নম্বর এবাদত হোসেনের সঙ্গেও দেখা মিলল অধিনায়ক আর খানিক অচেনা সাকিবের। স্টাম্প মাইকের কল্যাণে শোনা গেল, ‘সোজা করবে...তুই থাক...’, ‘তিন নাম্বার বলে কিছু নিব না, চার নাম্বার বলে নিব...’, ‘একটা বল খেলা লাগবে কিন্তু...।’
এতে অবশ্য খুব বেশি উপকার না হলেও দল পেরিয়েছে শতরান আর ব্যাটসম্যান সাকিব করেছেন টেস্টে ২৮তম অর্ধশতক। পরে আউট হয়েছেন আলজারি জোসেফের বলে বাউন্ডারি মারতে গিয়ে। ফিল্ডারের নাম কেমার রোচ। ২০০৯ সালে এই রোচকে উড়িয়ে মেরেই তো সিরিজ জয়টা নিশ্চিত করেছিলেন। লং অন, কেমার রোচ কিংবা সাকিব—সব যেন মিলে গেল একই বিন্দুতে।
তবে আউটের পর ব্যাটসম্যান সাকিবে ঠিক তৃপ্ত হতে পেরেছেন কি অধিনায়ক সাকিব? উত্তরটাও সাকিবই ভালো জানেন।