বোরেন তখন রোবেন, বারেসি হয়ে গেলেন ফন পার্সি, মাইবার্গ যেন স্নাইডার! ক্রিকেট অনুশীলনে ফুটবল সব সময়ই আনন্দময় এক উপস্থিতি। গা-গরমের জন্য প্রায় সব দলই ফুটবল খেলে আসছে অনেক দিন ধরে। কাল জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে হল্যান্ডের গা-গরমের ফুটবল দেখে মনে হচ্ছিল, ছোট্ট ওই চর্মগোলক নিয়ে ছোটাছুটি করার মতো মজার কিছু আর হয় না। অথচ বিশ্বকাপ আর ফুটবল এক বন্ধনীতে থাকা মানেই তো হল্যান্ডের জাতীয় ট্র্যাজেডি, চিরন্তন আক্ষেপ!
১৯৭৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্রুইফ-নিসকেন্সদের হার কিংবা হার পরের বিশ্বকাপের ফাইনালে, ১৯৯৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল হয়ে গত আসরের ফাইনাল, বিশ্বকাপ বরাবরই ডাচদের জন্য কান্না। তবে পিটার বোরেন তো আর সত্যি সত্যি আরিয়েন রোবেন নন, ওয়েসলি বারেসি নন রবিন ফন পার্সি। ফুটবল তাই কাল ডাচদের কাছে আনন্দের উৎস। ক্রিকেট বিশ্বকাপে ডাচদের ফুটবলচর্চায় বেশ মজা পেলেন দর্শকরূপী সাংবাদিক আর আইসিসি কর্তারাও।
সব সময় ট্র্যাজেডিতে শেষ হলেও ফুটবল বিশ্বকাপের সঙ্গে ডাচদের সম্পর্ক যতটা নিবিড়, ততটাই আলাদা ক্রিকেটের সঙ্গে। ক্রিকেটের বিশ্ব আসরগুলোয় সুযোগই মেলে কম! এবারও তাদের ধরে নেওয়া হয়েছিল ‘আউটসাইডার।’ প্রাথমিক পর্বের ছদ্মবেশ নেওয়া বাছাইপর্বে বাধা ছিল বিশ্বকাপ-নিয়তি। সবাইকে চমকে দিয়ে তারাই এখন কুলীন সুপার টেনের অংশ, পুরো ক্রিকেট-বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রে। কাল নিউজিল্যান্ড-শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি ভিড় ডাচ অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনে। উইলিয়ামসন-চান্ডিমালদের চেয়ে বেশি সময় কথা বলতে হলো পিটার বোরেনকে। তাঁর ক্রিকেট-ভাবনা আর কণ্ঠের দৃঢ়তাও মুগ্ধ করল সবাইকে। এই বিশ্বকাপের হল্যান্ড এক আনন্দময় বিস্ময়। ফুটবল বিশ্বকাপের চেয়ে ব্যতিক্রমী হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উৎসব আর উচ্ছ্বাসের রং কমলা!
এই মুগ্ধতা, ভালো লাগা, বিস্ময়—সবই এক ম্যাচের অর্জন। আরব আমিরাতের বিপক্ষে জয়টা অনুমিতই ছিল, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়টাও অপ্রত্যাশিত নয়। তবে অভাবনীয় ছিল সেই জয়ের ধরন। সুপার টেন উঠতে হলে ১৯০ তাড়া করে জিততে হতো ১৪.২ ওভারে। চোখ ধাঁধানো স্ট্রোকের দ্যুতিতে ডাচরা জিতেছে ৩ বল আগেই! চূড়ান্ত পর্বে জায়গার সঙ্গে সেই জয়ে উপহার ছিল রেকর্ডের মালাও।
এমনিতে ডাচদের ক্রিকেট ইতিহাসসমৃদ্ধ না হলেও অনেক পুরোনো। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ সেনারা সেখানে চালু করেছিলেন ক্রিকেট। ১৮৬০-এর দশকে জনপ্রিয়তার পাল্লায় সেটি হয়ে দাঁড়ায় অন্যতম প্রধান খেলা। রয়েল ডাচ ক্রিকেট বোর্ড গঠিত হয়েছিল সেই ১৮৮৩ সালে, আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ ১৯৬৬ সালে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটও খেলেছে তারা বাংলাদেশের আগেই, ১৯৯৬ সালে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের রেকর্ডও দারুণ। দুটি ওয়ানডে খেলে একটিতে বাংলাদেশকে হারিয়েছে, হারিয়েছে দুটি টি-টোয়েন্টির একটিতেও!
তবে নানা বাস্তবতায় এগোতে পারেনি ডাচ ক্রিকেট। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পর ২০০৩, ২০০৭, ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০১১ বিশ্বকাপে খেলতে পেরেছে। এত দিন সাফল্য বলতে ছিল ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়। সহযোগী দেশগুলোর মধ্যেও অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে, কদিন আগে হারিয়েছে ওয়ানডে মর্যাদা। সেই দলটার হাতেই এখন বিশ্বকাপে সহযোগী দেশগুলোর ঝান্ডা!
এই ঝান্ডাটা এগিয়ে নেওয়ার পথ বন্ধুর। অধিনায়ক পিটার বোরেন কিন্তু ভড়কে যাচ্ছেন না একটুও, ‘২০০৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোর স্মৃতি অনেকটাই মুছে গেছে অনেকের কাছে। এবার তাই নতুন করে কিছু করতে চাই। এত বড় মঞ্চে খেলার সুযোগ আবার কবে পাব বা আদৌ পাব কি না, কে জানে! আমরা ভীষণ রোমাঞ্চিত। সহযোগী দেশগুলোর একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে রেখে যেতে চাই নিজেদের ছাপ। এমন একটা কিছু করতে চাই, যাতে লোকে কমলা জার্সিটাকে মনে রাখে অনেক অনেক দিন।’
তেমন কিছু পারলে তো মনে রাখবেই, লোকে মনে রাখবে হয়তো আর বড় কিছু করতে না পারলেও। যা করেছেন বোরেনরা, সেটাই বা কম কী! অন্তত এটা তো দেখাতে পেরেছেন, বিশ্বকাপ মানেই বেদনার রং কমলা নয়, কখনো কখনো আনন্দ-উচ্ছ্বাসের রংও কমলা!