জাদুকর কখন টুপি খুলবেন আর বেরিয়ে আসবে অত্যাশ্চর্য এক খরগোশ...থুড়ি খরগোশ নয়, অত্যাশ্চর্য এক গোল!
বেলো হরিজন্তের মিনেইরো স্টেডিয়ামে কাল খুদে জাদুকর যখন টুপি খুললেন, নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ। অতিরিক্ত ৪ মিনিট যোগ করা হয়েছে। ম্যাচ হতে যাচ্ছে গোলশূন্য ড্র এবং যে ড্রয়েও একদল জয়ী হবে। সেই দলের নাম ইরান। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ড্র তো তাদের কাছে জয়েরই সমতুল্য।
তখনই ম্যাচের সুন্দরতম মুহূর্তটার জন্ম। বসনিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে যেখান থেকে শটটা নিয়েছিলেন, এবার নিলেন তাঁর একটু আগেই। আড়াআড়ি দৌড়টা যে এবার একটু সংক্ষিপ্ত। সেদিন পোস্টে লেগে গোলে ঢুকেছিল মাটি কামড়ানো শটটি। কাল বাতাসে বাঁক নেওয়া শট পোস্টের কোণ ঘেঁষে জালে। ইরানের গোলরক্ষক আলীরেজা হাগিগি শূন্যে ভাসলেন, কিন্তু এই শট ঠেকানোর সাধ্য আছে নাকি তাঁর!
এই বিশ্বকাপে তাহলে কি এটাই নিয়ম হয়ে থাকবে! আর্জেন্টিনা হাঁসফাঁস করবে আর তাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবেন লিওনেল মেসি নামে এক খুদে জাদুকর!
বসনিয়ার বিপক্ষেও গোলটির আগে বলতে গেলে কিছুই করতে পারেননি। কালও নয়। মাঠে বল ছাড়া এমনিতেই মেসিকে অদ্ভুত রকম নিরাসক্ত লাগে। কাল যেন তা আরও বেশি। টেলিভিশনে বল পায়ে গেলেই শুধু তাঁকে দেখায়। টেলিভিশন-দর্শকেরা তাই কল্পনাও করতে পারবেন না, পায়ে বল না থাকলে মেসি চারপাশের সবকিছু থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। কাছাকাছি বল না এলে দৌড়াদৌড়ির ধারই ধারেন না। দুলকি চালে হেঁটে বেড়ান। কখনো বা দাঁড়িয়েও থাকেন। খেলায় আছেন কি নেই, সংশয় জাগে এ নিয়েই।
তারপর হঠাৎই অমন একটা জাদুকরি মুহূর্তের জন্ম দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেন, আমার নাম লিওনেল মেসি। আমি যা করি তা আমার নিয়মে। এই যে দেখো, কেমন একটা গোল করে দিলাম!
ইরানের খেলোয়াড়দের অনেকে হতাশায় মাটিতে শুয়ে পড়লেন। চোখের সামনে এমন ঐতিহাসিক একটা ড্র চোখের নিমেষে পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর এটাই স্বাভাবিক। তাও যদি ইরান যাচ্ছেতাই খেলত! দ্বিতীয়ার্ধে তো খেলাটা সমানে সমানই হয়েছে।
প্রথমার্ধটা ইরান কোনোমতে ঠেকিয়েই কাটিয়েছে। নিজেদের গোলের সামনে পর পর দুটি দেয়াল তুলে দিয়েছে আর্জেন্টিনার সামনে। আর্জেন্টিনা তা ভাঙতে পারেনি। ইরানের খেলোয়াড়েরা দু-একবার বল নিয়ে একটু ওপরে উঠেই খেই হারিয়ে ফেলেছেন। স্পষ্টতই স্নায়ুর চাপ। দুটির জায়গায় তিনটি পাস খেলতে গিয়েই যেন তাদের মনে পড়ে গেছে—ওরে বাবা, প্রতিপক্ষের নাম আর্জেন্টিনা!
প্রথমার্ধটা গোলশূন্য রেখে দিতে পেরে বিরতির সময় যেন ইরানিয়ানদের উপলব্ধি হলো, ওরাও তো আমাদের মতোই মানুষ। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামল হীনম্মন্যতা ড্রেসিংরুমে রেখে। আর্জেন্টিনাকে কাঁপিয়েও দিল অনেকবারই। কাউন্টার অ্যাটাক খেলা খেললে যা হয়, ইরানের সুযোগগুলোই ছিল বেশি পরিষ্কার। ইরানের সবচেয়ে বড় তারকা ঘুচান্নেজাদ দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকেই সুবর্ণ এক সুযোগ নষ্ট করলেন। আশকান দেজাগার হেড কর্নার করে বাঁচালেন গোলরক্ষক রোমেরো। ম্যাচের সবচেয়ে বিতর্কিত মুহূর্তটিতেও ছিলেন দেজাগা। ৫৫ মিনিটে জাবেলাতার সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে গেছেন বক্সে। আসলে ফাউলের শিকার। পেনাল্টির জন্য রেফারির কাছে তীব্র দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলো রিপ্লেতে। জাবেলাতার পা বলের ছোঁয়াই পায়নি। ওটা পেনাল্টিই হয়।
আর্জেন্টিনা যে দু-একটা সুযোগ পায়নি, তা নয়। পেয়েছে। কিন্তু পুরো দলের মধ্যে এমন একটা সমন্বয়হীনতা যে, কখনোই মনে হয়নি এই দলটিকেই বেশির ভাগ লোকে এই বিশ্বকাপের ফেবারিট বলছে। ফর্মেশন নিয়ে কোচ সাবেলার সঙ্গে মেসির মতবিরোধ যেভাবে প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে পরিষ্কার, সাবেলার দাবিমতো সেটি শুধু গঠনমূলক আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আর্জেন্টিনা কাল খেলল মেসির পছন্দের ৪-৩-৩ ছকেই। শুরুতে দুপাশে মেসি ও আগুয়েরোকে রেখে মাঝখানে হিগুয়েইন। পরে মেসি চলে এলেন মাঝখানে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ইরানের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার দেয়াল ভাঙতে যে সৃষ্টিশীলতা লাগত, সেটির ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না বিখ্যাত ত্রয়ীর কাছ থেকে।
শেষ পর্যন্ত এক টুকরো মেসি-জাদুই লাগল। টানা দুই ম্যাচ জিতে নিশ্চিত হয়ে গেল আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় রাউন্ডও। তবে সাবেলার দলকে নিয়ে প্রশ্নটা কিন্তু আরও বড়ই হয়ে উঠল এই ম্যাচের পর। জাদুকরেরও তো ভালো-মন্দ দিন থাকে। মেসি যেদিন পারবেন না, আর্জেন্টিনা সেদিন কীভাবে পার পাবে?
যেদিন যখন আসবে, আসবে। আপাতত না-হয় টেলিভিশনে, ইউটিউবে বারবার দেখতে থাকুন জাদুর ওই ঝলক!