লাউড স্পিকারে বেজে চলা সংগীতের মূর্ছনায় হারিয়ে যাচ্ছিল কথাগুলো। তবু শেন জার্গেনসেনের চেহারায় ফুটে ওঠা আবেগের ভাষাটা পড়তে অসুবিধা হয়নি। ছলছল চোখ আর কম্পিত গলায় পেশাদার অস্ট্রেলিয়ান কোচও যেন এ দেশেরই একজন সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী। বাংলাদেশের জয় কোটি কোটি বাঙালির মতো আবেগে ভাসায় তাঁকেও।
২-০-এর পর ৩-০। মানে আরেকটি ‘বাংলাওয়াশ’। একের পর এক পরাজয়ে নিউজিল্যান্ডের মতো দলও আরেকবার নিজেদের হারিয়ে খুঁজে ফিরল বাংলার মাটিতে। আর বাংলাদেশ দল? শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের পর ফতুল্লা স্টেডিয়ামেও জানাল বিজয়ের লাল-সবুজ অভিবাদন। সাত বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরে পাওয়া এই মাঠের বুকেও আঁকা হলো গৌরবতিলক।
নিউজিল্যান্ড ৩০৭/৫। বাংলাদেশ ৩০৯/৬। স্কোরশিটের সারাংশই বলে দিচ্ছে ৪ উইকেটে শেষ ওয়ানডে জেতা বাংলাদেশ দল কী উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাসে ফুটছিল। নিউজিল্যান্ড দলের ইনিংসের হাইলাইটস বলতে পারেন ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি করা রস টেলর (১০৭*) আর কলিন মানরোর (৮৫) ১৩০ রানের চতুর্থ উইকেট জুটিটাকে। অ্যান্টন ডেভচিচ (৪৬) ও টম ল্যাথামের (৪৩) ওপেনিং জুটিতে ৬৬ রান দিয়ে শুরু ইনিংসটা ৫ উইকেট হারিয়েই ৩০৭ রানের পাহাড়ে উঠল কিউই মিডল অর্ডারের ওই মানসিক বদলে।
পাহাড়! শামসুর-নাঈম-নাসিরদের অভিধানে শব্দটা বোধ হয় কাল ছিল না। ৩০৮ রানের জয়ের লক্ষ্যও ৪ বল আগে হাতের মুঠোয়। দ্বিতীয়বার তিন শ রান তাড়া করে জয়। ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়ের পর প্রথম। টানা দ্বিতীয়বার নিউজিল্যান্ডকে বাংলাওয়াশ! সিরিজের শুরু থেকে প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে এই ‘বাংলাওয়াশের’ কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে মুশফিক-মাশরাফিদের। কিন্তু দলের কেউ কখনোই মুখ ফুটে বলেননি, ‘আমরাও চাই বাংলাওয়াশ’। মুখে কথাটা না বললেও অন্তরে ছিলই। কাল ল্যাপ অব অনার থেকে বেরিয়ে তামিম ইকবাল গ্যালারির এক দর্শকের কাছ থেকে ‘বাংলাওয়াশ’ লেখা পোস্টারটা চেয়ে নিজেই দুই হাতে তুলে ধরলেন কেন? গোপন ইচ্ছা পূরণের আনন্দেই তো।
ল্যাপ অব অনারে সঙ্গী হলেও তামিম ছিলেন না একাদশে। তাঁর বিশ্রামের সুযোগে শামসুর রহমানের সঙ্গে ওপেনিং জুটি গড়েছিলেন জিয়াউর রহমান। উইকেটে বেশি সময় থাকতে পারেননি জিয়া, ড্রেসিংরুমে ফিরলেন অষ্টম ওভারেই। কিন্তু পাহাড় টপকানো ইনিংসের ইঞ্জিন ২০ বলে ২২ রান করে তাতিয়ে দিয়ে গেছেন ওই সময়টুকুতেই।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাত্র ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরি না পেলেও ইনিংসের নেতৃত্ব থাকল শামসুরের ব্যাটে। সাত বাউন্ডারির সঙ্গে চারটি বিশাল ছক্কা—ঘরোয়া ক্রিকেটের পোড়-খাওয়া এই ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি মিস করেও ম্যাচ শেষে অনেক উজ্জ্বল, ম্যান অব দ্য ম্যাচও। দ্বিতীয় উইকেটে শামসুর-মুমিনুলের ৬৫ রানের জুটিতে ১৬তম ওভারে ১০০ পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ম্যাচে প্রবলভাবেই ছিল বাংলাদেশ। ২ ওভারের মধ্যে ১২৬ রানে মুমিনুল আর ১২৯ রানে মুশফিকুরের বিদায় সাময়িকভাবে হলেও একটা চাপ সৃষ্টি করেছিল সত্যি, কিন্তু সে চাপও টেকেনি। শামসুরের সঙ্গে সিরিজজুড়েই ধারাবাহিক ব্যাটিং করা নাঈম আর শেষ ম্যাচে নিজেকে ফিরে পাওয়া নাসির যেন চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রমাণ করলেন, নিউজিল্যান্ডকে হারানো আসলেই এখন সহজ কাজ। শেষ ৫ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৩৫ রান, ২ ওভারে সেটা কমে ১২। শেষ ওভারে মাত্র ৩। ৩০৭ রান তাড়া করার ম্যাচেও যে রান-বলের হিসাবটা শেষ ওভার পর্যন্ত জমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে টিকে থাকল না, বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতায় লিখে রাখতে হবে সেটাও।
তিন ম্যাচে রান ৮৪, ১৬, ৬৩—সাকিব আল হাসান অসুস্থ না হলে যাঁর এই সিরিজেই খেলার কথা নয়, সেই নাঈমের এমন ধারাবাহিকতাকে নিউজিল্যান্ড সিরিজের আরেকটা প্রাপ্তি বলতে পারেন। ৩ রানের মধ্যে মুমিনুল, মুশফিকের বিদায়ে বাংলাদেশের ইনিংসে একটা কাঁপুনি ধরেছিল বটে। নাঈম সেটাকেই সিলগালা করে বাঁচিয়ে রাখেন জয়ের আশা। ম্যাচ শেষে কোচের মুখে তাই আলাদা করে নাঈমের প্রশংসা, ‘পুরো সিরিজে তার যে রকম পারফরম্যান্স সেটা এককথায় অসাধারণ।’ প্রশংসা প্রাপ্য নাসিরেরও। প্রথম দুই ম্যাচে ভালো কিছু করতে না পারায় ভেতরে ভেতরে আফসোসে পুড়ছিলেন। সেই আফসোস কাল উবে যাওয়ার কথা কৃপণ বোলিং (১০-১-৩৩-০) আর অপরাজিত ৪৪ রানের দায়িত্বশীল ইনিংসে। কখনো নাঈম, কখনো মাহমুদউল্লাহ, কখনো বা সোহাগ গাজীকে সঙ্গে নিয়ে বিজয়ের ক্যানভাসে তুলির শেষ আঁচড়টা তো দিলেন তিনিই!
৬ নভেম্বরে মিরপুরে একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে শেষ হবে নিউজিল্যান্ড দলের এবারের বাংলাদেশ সফর। ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক রসিকতা করে প্রশ্ন ছুড়লেন, টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা জিতলে তো এবারের সিরিজও ৪-০ হয়। অধিনায়ক মুশফিক অত দূর ভাবতে চাইলেন না তখনই, ‘আপাতত ৩-০ জয়টা উপভোগ করতে চাই...।’
উপভোগ করুক বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। হরতাল-হানাহানির মধ্যে এ দেশের ক্রিকেট দল বিজয়ের তৃপ্তি দেয়। সেই তৃপ্তিও শিখরছোঁয়া—ধবলধোলাইয়ের!
নিউজিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ৩০৭/৫
বাংলাদেশ: ৪৯.২ ওভারে ৩০৯/৬
ফল: বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী