বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনী ও প্রাইম ব্যাংকের খেলা শেষ হয়েছে সেই বিকেলে। রোজার মাস। খেলা শেষ হতে না হতেই মাঠ ফাঁকা। সদ্য দক্ষিণ আফ্রিকাফেরত মুমিনুল হক কী মনে করে সেদিন মাঠ ছাড়ছিলেন না।
সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মুমিনুলের স্বপ্নিল চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করছিল...বাংলাদেশ টেস্ট দল নিয়ে স্বপ্ন। কেন টেস্ট দল ধারাবাহিক নয়, কীভাবে উন্নতি সম্ভব, কীভাবে পেস বোলারদের ম্যানেজ করবেন, কোন বোলারদের কোন জায়গায় উন্নতি দরকার—আরও কত কী!
তখন বাংলাদেশ দল দক্ষিণ আফ্রিকায় দুটি টেস্ট হেরে এসেছে। দুই টেস্টেই বাংলাদেশ দল শুরুটা ভালো করেও শেষটা হয়েছে ভুলে যাওয়ার মতো। ডারবান ও পোর্ট এলিজাবেথের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ ও ৮০ রানে অলআউট হওয়া নিশ্চয়ই সুখকর স্মৃতি নয়। দুই টেস্টেই মুমিনুলের রান দুই অঙ্ক (০, ২, ৬, ৫) পার করতে পারেননি।
সংখ্যাগুলো অবশ্য মুমিনুলকে অতটা স্পর্শ করছিল না, যতটা করছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের নীতিনির্ধারক ও সমর্থকদের। সবার মনে একটাই প্রশ্ন—কী হলো মুমিনুলের? তাঁর ব্যাটে রান-খরা নিয়ে এতটাই হইচই হলো যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা পর্যন্ত মুমিনুলকে ফোন করে বসলেন, ‘তুই ঠিক আছিস তো? কিচ্ছু ভাবিস না। বাইরের কথায় কান দিবি না।’
মুমিনুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বড় ভাইয়ের হঠাৎ ফোনে একটু অবাকই হন। কারণ, তখন পর্যন্ত মুমিনুলের ভাবনাটা এমন, রান হচ্ছে না তো কী হয়েছে! বড় রান খুব বেশি দূরে নয়। তবে মাশরাফির ফোনে মুমিনুল অবশ্য খুশি হয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় বারবার একটা কথাই তিনি বলছিলেন, ‘আমি একদম চিল আছি। এসব নিয়ে একদম ভাবছি না।’
এসবই মাত্র দুই টেস্ট আগের ঘটনা। মাত্র দুই টেস্ট। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্ট ড্র হওয়ার পরও হয়তো মুমিনুল ‘চিল’ই ছিলেন। মিরপুর টেস্ট থেকেই যা বদলে যাওয়ার শুরু। প্রথম ইনিংসে ৯ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য। এরপর সেই শান্ত, আত্মবিশ্বাসী মুমিনুল আর অধিনায়কত্বের মশাল উঁচিয়ে রাখতে পারলেন না। ঘোষণা দিলেন—আমার পালা শেষ।
মুমিনুলের নেতৃত্বে ১৭টি টেস্ট খেলে বাংলাদেশ জিতেছে ৩টিতে, ড্র ২টি। এর মধ্যে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়টিও আছে, বাকি দুটি জয় এসেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ব্যাট হাতে সম্প্রতি রান-খরায় ভুগলেও এই তিন টেস্টেই ব্যাটসম্যান মুমিনুল ছিলেন উজ্জ্বল। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুটি জয়েই অবদান ছিল তাঁর ১৩২ ও ৭০ রানের ইনিংসের। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও খেলেছেন ৮৮ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।
কিন্তু গত মার্চ-এপ্রিলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত দুই টেস্টের সিরিজেও মুমিনুলের দল প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামে ড্র করলেও মিরপুরে ১০ উইকেটে হারা ম্যাচে ব্যাটিংটা ভালো হয়নি দুই ইনিংসেই। মুমিনুল লড়ছেন নিজের সঙ্গেও। সর্বশেষ ৯ ইনিংসে দুই অঙ্ক ছুঁয়েছেন মাত্র একবার। শ্রীলঙ্কার সিরিজের তিন ইনিংসে মুমিনুলের রান ২, ৯ ও ০। মুমিনুলের উপলব্ধি, নিজে ভালো খেলতে পারছেন না বলে দলকেও তিনি উজ্জীবিত করতে পারছেন না।
শুধু মুমিনুল নন। টেস্ট দলের কোনো বাঁহাতি ব্যাটসম্যানই ধারাবাহিকভাবে রান পাচ্ছেন না। প্রত্যেকের কৌশলগত সমস্যাও একই। সবাই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা ডানহাতি পেসারের বলে ধুঁকছেন। ২০১৯ সালের পর মুমিনুল ২০ ইনিংসে খেলে ৬ বার রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা ডানহাতি পেসারের বলে আউট হয়েছেন। মুমিনুলের মতো সমান ৬ বার আউট হয়েছেন নাজমুল হোসেন, তবে নাজমুলের ইনিংস ১২টি। তামিম ইকবাল ১২ ইনিংস খেলে ৩ বার আউট হয়েছেন একই ধাঁচে। এ তালিকায় সবার ওপরে সাদমান ইসলাম, ১৬ ইনিংস খেলে যিনি আউট হয়েছেন ৭ বার। একই সমস্যা আছে সাকিবেরও। চার ইনিংসে সাকিব আউট হয়েছেন দুবার।
বাঁহাতিতে ঠাসা বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং অর্ডারের এই সমস্যা শুধু যে মুমিনুলের নয়, সেটি তো সংখ্যাই বলছে। কিন্তু অধিনায়ক হওয়ায় চড়া মূল্যটা দিতে হয়েছে মুমিনুলকে। শ্রীলঙ্কার পেসার কাসুন রাজিতার বলে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের আউটগুলো মনে আছে তো? তামিম, নাজমুল, মুমিনুল, সাকিব—সবাই আউট হয়েছেন রাজিতার রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা বোলিংয়ে। কোন দুজন লঙ্কান দুই পেসারকে সবচেয়ে ভালো খেলেছেন? বাংলাদেশ দলের দুই ডানহাতি লিটন দাস ও মুশফিকুর রহিম।
আর এ সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশের, সেটিও নয়। টেস্ট ক্রিকেটে সব বাঁহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের দুঃস্বপ্ন এখন ডানহাতি বোলারদের রাউন্ড দ্য উইকেট বোলিং। এলবিডব্লু, বোল্ড ও কট বিহাইন্ড—টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে সাধারণ তিনটি ডিসমিসালের সুযোগ তৈরি হয় তখন। বেড়ে যায় সাফল্যের হারও।
টেস্ট বোলারদের অবশ্য এই কৌশল বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। গত পাঁচ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে ডানহাতি বোলারদের রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে বোলিং করার হার ৪০ শতাংশ। এর আগের ১০ বছরে যা ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা বোলারদের উইকেট নেওয়ার গড় ২৭। ওভার দ্য উইকেটে গড় ৩৭। এর আগের ১০ বছর রাউন্ড দ্য উইকেটে গড় ছিল ৩৮, ওভার দ্য উইকেটে ৩৭।
বলতে পারেন, বদলে যাওয়া টেস্ট বোলিংই সমাপ্তি টেনে দিল মুমিনুলের টেস্ট অধিনায়কত্বের। অধিনায়কত্ব তো ছাড়লেন, কিন্তু ব্যাটসম্যান হিসেবে চ্যালেঞ্জটা তো থাকছেই। খুব শিগগির যে এর সমাধান হবে, সেই সম্ভাবনাও কম। নতুন ধারার এই বোলিংয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে টেকনিক নিয়ে কাজ করতে হবে সব বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকেই। সে জন্য দরকার সময়, যা মুমিনুল-তামিমদের হাতে নেই বললেই চলে।
যে পেস বোলিং মুমিনুলের অধিনায়কত্ব হারানোর বড় কারণ, নিজ দলে সেই পেস বোলিং সংস্কৃতিটা বলতে গেলে শূন্য থেকে গড়ে তুলছিলেন মুমিনুল। তাঁর সরে যাওয়াতে ফাস্ট বোলিংয়ের গুরুত্ব বোঝেন, এমন একজন অধিনায়ককেও হারাল বাংলাদেশ। মাঠের বাইরেও সার্বক্ষণিক যিনি অধিনায়কের কাজটা করেছেন। চোট বা সমন্বয়ের কারণে দলের বাইরে থাকা ক্রিকেটারদের সারা বছর অনুপ্রাণিত করে রাখতেন। তরুণ সম্ভাবনাময় পেসার দেখলেই বলতেন, ‘রেডি থাকিস।’ টেস্ট দলের পেসারদের অধারাবাহিকতা, বাজে পারফরম্যান্সের সময় পিঠে হাত রেখে তাঁদের অনুপ্রাণিত করতেন।
এখন টেস্ট পেসারদের ভয়, আবার বাংলাদেশ এক পেসারের দলে পরিণত হবে না তো? আবার ঘরের মাঠে ‘প্যাসেঞ্জার’ থেকে বিদেশের ‘ড্রাইভার’ হবেন না তো ইবাদতরা? মুমিনুল সরে যাওয়ার পর এক পেসার সেদিন বলছিলেন, ‘সৌরভ (মুমিনুল) ভাই সেদিনও বলছিল, আর দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে তোদের দাঁড় করিয়ে দেব। এরপর ছেড়ে দেব। সৌরভ ভাইয়ের মতো সাপোর্ট কি সবাই দেবে?’
ভালো উইকেটে খেলা, ঘরের মাঠে পেস বোলারদের দিয়ে বোলিং আক্রমণ সাজানোর সাহস তো মুমিনুলই প্রথম দেখিয়েছেন। চাইলেই এক দল স্পিনার নিয়ে ঘরের মাঠে উল্লাসনৃত্য করতে পারতেন তিনি। কিন্তু তাতে তাসকিন, শরীফুল, ইবাদত, খালেদরা তৈরি হতেন না।
এখন টেস্ট পেসারদের ভয়, আবার বাংলাদেশ এক পেসারের দলে পরিণত হবে না তো? আবার ঘরের মাঠে ‘প্যাসেঞ্জার’ থেকে বিদেশের ‘ড্রাইভার’ হবেন না তো ইবাদতরা? মুমিনুল সরে যাওয়ার পর এক পেসার সেদিন বলছিলেন, ‘সৌরভ (মুমিনুল) ভাই সেদিনও বলছিল, আর দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে তোদের দাঁড় করিয়ে দেব। এরপর ছেড়ে দেব। সৌরভ ভাইয়ের মতো সাপোর্ট কি সবাই দেবে?’
মুমিনুলের বিদায়ে বাংলাদেশ টেস্ট দলের বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে একটা শঙ্কাও। তৃতীয় মেয়াদে অধিনায়কের দায়িত্ব নেওয়া সাকিবের আমলেই তো বাংলাদেশ কোনো পেসার ছাড়া একাদশ সাজিয়েছিল। অধিনায়কত্বের নতুন অধ্যায়েও তিনি আবার স্পিননির্ভর হয়ে যান কি না, কে জানে!