বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে নেওয়া প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হতে যাচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে আড়াই বছর আগে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের পাশাপাশি সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্যই প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হতে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ করতে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বাকি ২৮০টির মধ্যে ৩টির কাজ শেষের পথে। আর ১২টির কাজ শুরু হওয়ার কথা জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যই বলছে, আড়াই বছরেও ২৬৫টি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি। কবে কাজ শুরু হবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সেটি বলতে পারছেন না। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ আছে আর মাত্র ছয় মাস।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে একটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার দাবি করেছে সেটি হচ্ছে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বাড়ৈবাড়ি বধ্যভূমি। তবে সরেজমিনে পরিদর্শন, প্রকল্পের ঠিকাদার ও স্থানীয় গণপূর্ত কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ ফুট উঁচু স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণকাজ আগামী বছরের মার্চ মাসে শেষ হবে। এ প্রকল্পের জন্য গত ১৯ জুলাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৬২ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগের পিরোজপুর কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী উজ্জল চন্দ্র ব্যাপারী বলেন, কাজের অগ্রগতি ভালো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে।
মঠবাড়িয়ার বাড়ৈবাড়িতে ১৯৭১ সালের ২১ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ-দেশীয় সহযোগী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১১ জনকে হত্যা করে। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র বিশ্বাস (৭০) বলেন, বাড়ৈবাড়ি গণহত্যায় নিহতদের অনেককে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
এখন পর্যন্ত মাত্র একটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ করতে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বাকি ২৮০টির মধ্যে ৩টির কাজ শেষের পথে। আর ১২টির কাজ শুরু হওয়ার কথা জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
‘১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয়, ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৪৪২ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত ২৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভায় এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে তিনটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষের পথে বলছে, এর মধ্যে দুটি এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ ৭৫ ভাগ শেষ হয়েছে। আর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আটানি বাজার বধ্যভূমির নির্মাণকাজ শেষের পথে। টাইলস বসানো ও রং করার কাজ এখনো বাকি আছে। প্রকল্পের ঠিকাদার, উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাতক্ষীরার তালার জালালপুরে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে নারী-শিশুসহ ১৮ জনকে হত্যা করে। ওই ঘটনা স্মরণে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ হচ্ছে। তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ৫ ফুট বেদির ওপর ২০ ফুট পিলার নিয়ে জালালপুর স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতা হবে ২৫ ফুট। আগামী বছরের ২৫ মার্চ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করা হতে পারে।
গত দুই বছর কোনো প্রকল্প পরিচালকই ছিল না। তিনিও মন্ত্রণালয়ের সনদ শাখার দায়িত্বে আছেন। তাঁকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের কাজ দেওয়া হয়েছে।দুলাল কৃষ্ণ রায়, প্রকল্প পরিচালক, বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প
বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক দুলাল কৃষ্ণ রায় প্রকল্পের অস্বাভাবিক ধীরগতির দায় নিতে রাজি নন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই বছর কোনো প্রকল্প পরিচালকই ছিল না। তিনিও মন্ত্রণালয়ের সনদ শাখার দায়িত্বে আছেন। তাঁকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের কাজ দেওয়া হয়েছে। বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজে তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকার সাংসদ, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি লিখে সহযোগিতা চেয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যেসব জায়গা বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য নকশা অনুযায়ী ১৯ শতাংশ জমি লাগার কথা থাকলেও সেই পরিমাণ জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এ সমস্যা দূর করতে উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমিয়ে স্থাপত্য নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। এ ছাড়া সরকারি খাসজমিতে বধ্যভূমি থাকলে তা ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এক হাজার টাকার প্রতীকী মূল্যে বন্দোবস্ত নেওয়া এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে বধ্যভূমি থাকলে প্রচলিত অধিগ্রহণের নিয়ম অনুসরণ করার বিধান রয়েছে।
মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ আগামী বছরের মধ্যে দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলে আমি আশাবাদী। সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন জমির সংকট কিছুটা দূর হয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, একজন কর্মকর্তাকে নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি প্রকল্পের কাজ করতে হয়। এর ফলে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে গণপূর্ত বিভাগসহ অন্যদের যে সহযোগিতা দেওয়ার কথা ছিল, তাদের সহযোগিতার অভাব ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ-দেশীয় দোসররা বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণকবর দিয়েছিল। আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে এসব গণকবর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সংরক্ষণের কথা সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে বলা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চললেও বধ্যভূমি সংরক্ষণে জোরালো তৎপরতা দেখা যায়নি।
বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ আগামী বছরের মধ্যে দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলে আমি আশাবাদী। সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন জমির সংকট কিছুটা দূর হয়েছে।আ ক ম মোজাম্মেল হক, মন্ত্রী,মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কেন মন্ত্রণালয়ের এত অনীহা, তা জানা নেই। সারা দেশের বধ্যভূমি সংরক্ষণের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে এবং দ্রুত করতে হবে। প্রয়োজনে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ করেছেন বা করছেন, তাঁদের যুক্ত করতে পারে, পরামর্শ নিতে পারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ৫০ বছরেও বধ্যভূমি সংরক্ষণ না করতে পারাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।