শহীদ বুদ্ধিজীবী: আমার স্বামী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে কোটি মানুষের স্বপ্নে, বীরত্বে, ত্যাগে। ইতিহাসে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা উজ্জ্বল হয়ে আছেন আত্মত্যাগের মহিমায়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে প্রথম আলোর আজকের এ আয়োজন।

ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বেদি। অগণিত মানুষ পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি।

দুই দশক পর সেই স্মৃতিকথা লিখতে বসে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কলম এগোতে চায় না। কী হবে লিখে? নতুন করে আবার মনের গহন থেকে দুঃখ উসকে তুলে কী লাভ?

তার চেয়ে এই ভালো, আমার দুঃখ আমার হয়েই থাক। কিন্তু আমার স্বামী তো দেশের মঙ্গল চেয়ে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নিরুদ্বেগ। স্বাধীনতার জন্য তাঁর আত্মাহুতি তাই নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিত।

আমার স্বামী ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ (নরেন্দ্রনাথ ঘোষ: চিকিৎসক, সাটুরিয়া থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মানিকগঞ্জ) একাত্তরের শহীদ। সাধারণ্যে ডা. নরেন ঘোষ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন।

১৯৩৬ সালে টাঙ্গাইলের করটিয়ার মাদারজানি গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা স্বার্গীয় ফটিকচন্দ্র ঘোষ। তিনি তাঁর পুত্রের মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন কিছুকাল। ব্যক্তিজীবনে নরেন যেমন ছিলেন অমায়িক ও মৃদুভাষী, পারিবারিক জীবনেও ছিলেন শান্ত, ভদ্র ও আন্তরিক। তাঁর জীবনদর্শনই ছিল উন্নত চিন্তা ও সহজ-সরল জীবনযাপন। সব সময় বাহুল্য ও চাকচিক্য বর্জন করে চলতেন তিনি। সম্পদের প্রতি লোভ তাঁর কখনোই ছিল না। যা আয় করতেন, গরিব রোগীদের চিকিৎসা-শুশ্রূষায় তা অকাতরে ব্যয় করে দিতেন। ফুটবল ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। ভালো গানও গাইতে পারতেন আমার স্বামী।

নৃত্যকলায়ও তাঁর দখল ছিল। খুব সুন্দর আবৃত্তি করতেন। ডা. নরেন্দ্রনাথের শিক্ষাজীবন শুরু হয় তাঁর নিজ গ্রামে। ১৯৫২ সালে করটিয়া এইচ এম ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৪ সালে করটিয়া সা’দত কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫৬ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি এমবিবিএস পাস করে ১৯৬৮ সালে ক্যানসারের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন।

দীর্ঘ পাকিস্তানি শাসনকালে বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিমাদের শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিকার আকাঙ্ক্ষার প্রতি তিনি বরাবরই ছিলেন সহানুভূতিশীল। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। এ সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও নানা প্রকার সাহায্য দিয়ে ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষ শত্রুদের টার্গেটে পরিণত হন। পুরো যুদ্ধের সময় তাঁকে একটি রাতের জন্যও আমি কাছে পাইনি। সারা দিন অফিসে কাজ করে কোনো বিশ্রাম না নিয়ে চলে যেতেন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানায়। সেখানেও তিনি চিকিৎসকের হাত দিয়ে যুদ্ধ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। ভোররাতে ক্লান্ত হয়ে ফিরতেন আহত মুক্তিসেনাদের সেবা-শ্রুশ্রূষা করে। কখনো জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘মায়ের জন্য কিছু করে যাই।’ হায়! দেশপ্রেমই তাঁর কাল হলো। ’৭১-এর ১১ সেপ্টেম্বর সাটুরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্থানীয় কতিপয় রাজাকার ও আলবদরের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে হত্যা করে গোপনে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করার অপরাধে।

হিন্দু আইনে পিতার জীবদ্দশায় সন্তান নিহত হলে সম্পত্তি পাওয়া যায় না। তাই শহীদ ডা. নরেন্দ্রনাথ ঘোষের পৈতৃক বিপুল সম্পত্তি থাকলেও আমরা তার কিছুই পাইনি। গত ২০টি বছর ধরে চারটি সন্তান নিয়ে আমাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। কোনো সহায়তা কখনো মেলেনি। আমাদের বড় মেয়েটি বিএ পাস করে বর্তমানে জিপিওতে চাকরিরত। বড় ছেলে বিএ পাস করে এখন বিদেশে চাকরি করছে। মেজ মেয়ে বিএসসি পড়ছে এবং ছোট মেয়েটি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদটিকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ‘মুক্ত’ বাংলাদেশ আমাদের অবহেলা আর বঞ্চনা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। আমার স্বামীর ঘাতকেরাই আজ সদর্পে সবখানে বহাল তবিয়তে সমাসীন। সেই ঘাতকদের কোনো বিচার হয়নি। কার কাছে আমি বিচার চাইব?

কে আমাদের প্রশ্নের জবাব দেবে?
আমাদের বেদনার কি কোনো উপশম কোনো দিনই হবে না?

সূত্র: স্মৃতি ১৯৭১. দ্বিতীয় খণ্ড (সম্পাদনা: রশীদ হায়দার, পুনর্বিন্যাসকৃত প্রথম সংস্করণ ২০১৮, বাংলা একাডেমি) গ্রন্থ থেকে।